মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে প্রবাসী বাংলাদেশীসহ দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। প্রকৃতির নিয়মে ছোট থেকে আজ অনেক বড় হয়েছি। স্বদেশ ছেড়ে বসবাস করছি প্রবাসে সিঙ্গাপুর। ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির সবচেয়ে আনন্দের দিন। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির দিন। এদিন বিশ্বের মানচিত্রে সৃষ্টি হয় নতুন একটি সার্বভৌম দেশ, বাংলাদেশ। যা বাঙালি জাতিকে এনে দেয় আত্মপরিচয়ের ঠিকানা। যারা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে এ বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন আজ সেসব শহীদকে বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় স্মরণ করছে দেশের সর্বস্তরের মানুষ। বাংলার দামাল মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিপাগল মানুষের প্রবল প্রতিরোধ আর লড়াইয়ের মুখোমুখি হয়ে বাংলাদেশের কাছে পরাজিত হয়ে এই দিনে আত্মসমর্পণ করেছিলো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ৪৫ বছর আগে আজকের এই দিনে পূর্ব আকাশে উদয় হয়েছিলো হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সূর্য।সেদিনের সেই সূর্যের আলোয় ছিলো নতুন দিনের স্বপ্ন। আর এই স্বপ্নের জন্য অকাতরে প্রাণ দিয়েছিলেন ৩০ লাখ মানুষ। তাদের প্রাণের বিনিময়ে আমাদের এই বিজয়,এই স্বাধীনতা। সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন নিয়ে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছিলো এ দেশ। বিজয়ের এ দিনে সবার অঙ্গীকার সুন্দর ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার।যেসব বৈষম্য থেকে স্বাধীনতার জন্ম সেই বৈষম্যগুলো থেকে এ জাতি বেরিয়ে আসতে আবার দৃঢ় প্রত্যয় নেবে আজকের নবীনরা।
বছর ঘুরে বিজয় দিবস আসে বিজয় দিবস যায়। ৩৬৪ দিন পর আবার এসেছে ১৬ ডিসেম্বর। রাত ১২ টায় রাষ্ট্রপতি,প্রধানমন্ত্রী সহ বিভিন্ন দলের নেতা-নেত্রীবৃন্দ পুষ্প অর্পণ করেছে জাতীয় স্মৃতিশৌধে।আবার অনেকে শীতের সকালে কম্বলের নীচ থেকে বের হয়নি।
আবারও লেখা হবে অসংখ্য কবিতা আর অসংখ্য গদ্য। শহীদের কান্না আর বিজয়ের আনন্দের অশ্রুতে গাওয়া হবে আরো কতো অজস্র গান। চেয়ার টেবিল ভাড়া করে মঞ্চায়িত হয়েছে সারা দেশে অগণিত সেমিনার। আবারো ৬৫ বছরের বৃদ্ধ বুদ্ধিজীবি,তরুন-তরুনী , ছাত্র-শিক্ষকদের সমম্বয়ে যাত্রা করেছে র্যালী।আর ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে স্মৃতিশৌধ।টিভি চ্যানেল গুলোতে শুরু হয়েছে নাটক আর টেলিফিল্ম। বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্টানের সৌজন্যে আমরা দেখছি বিজয়ের নাটক।ঠিক যেমনটি দেখেছি বছরের পর বছর থেকে।
কিসের জন্য এই উৎসব! কোথায় সেই বিজয়! কোথায় আজ আমার দেশের স্বাধীনতা!কোথায় আজ আমার দেশে নাগরিকদের স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকার গ্যারান্টি! মুক্তিযুদ্ধ না করে মুক্তিযোদ্ধা সেজেছে যারা ; তাদের মুখেই আজ শুনতে হয় প্রতিনিয়ত প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কে নিয়ে অপমান অপদস্থ করার বুলি। তাহলে কি আমাদের শহীদের রক্তের উপর যে সবুজ ঘাস জন্মেছে সে জন্য এই উৎসব! নাকি বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা কাঁশতে কাঁশতে রিকশা চালাচ্ছে সেই উল্লাসে! নাকি জীবন বাঁচাতে বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা ফেরি করে চটপটি-চানাচুর বিক্রি করার দৃশ্য দেখে এই আনন্দ উল্লাস! কষ্ট লাগে যখন দেখি দরিদ্র,পঙ্গু, নুয়ে পড়া মুক্তিযোদ্ধা ময়লা কুচকানো পাঞ্জাবী পড়ে হুইল চেয়ারে বসে আছেন। রাষ্ট্রপতি এগিয়ে গিয়ে তাদের সাথে হাত মিলাচ্ছেন চারিদিকে সাংবাদিকগন ছবি তুলতে ব্যস্ত।
আরো দেখেছি সেমিনারের প্রথম সারিতে বসে আছেন মুক্তিযোদ্ধা আর রাজসিংহাসনের মত দশ ফুট উচু অশ্লীল মঞ্চের প্রধান অতিথির রাজকীয় চেয়ারে বসে আছেন কোন একজন মন্ত্রী! মন্ত্রী নামক মানুষটা যখন তার লোমশ হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ক্রেষ্টতুলে দেন, আর সেই মুক্তিযোদ্ধা বোকার মত হাসতে হাসতে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে থাকেন। যখন দেখি কোন বিরাঙ্গনা ত্যাগের গল্প খুবই দরদ দিয়ে মুখ দিয়ে প্রসব করছেন; মুক্তিযুদ্ধ না করেও ক্ষমতার বলে নিজ নামে মুক্তিযোদ্ধের সনদ বানিয়ে আজ ঐ মঞ্চে আসন দখল করে বসে আছে কিছু ভন্ড মুক্তিযোদ্ধারা।
যখন দেখি এসকল ভন্ডদের মতাদর্শ আর দলভূক্ত না হওয়ার কারণে "শিমলার" বাবার মতো অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ কেড়ে নেয় এই ভন্ডের দল। তখন বিজয় দিবস শব্দটা আমার কাছে পৃথিবীর সব চাইতে অশ্লীলতম শব্দ মনে হয়। তখন আমার মনে হয় ঐ দূর আকাশের তারা হয়ে যাওয়া ৭১ এর অগণিত বীর শহীদরা হয়তো তখন অট্টহাসীতে ফেটে পড়েন। কারন তাদেরকে এই অশ্লীল অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে যেতে হয়নি তারা যেনো সেদিন শহীদ হয়ে প্রাণে বেঁচে গেছেন।
কে জানে ১৭ ডিসেম্বরে আবারো রাস্তায় দেখা যাবে ভিক্ষারত সেই মুক্তিযোদ্ধাকে যিনি ১৬ ডিসেম্বর বসে ছিলেন কোন এক সেমিনারের প্রথম সারিতে। কে জানে যে মন্ত্রীর হাত ক্রেষ্ট তুলে দিয়েছিলো সেই হাতে স্বাক্ষরিত হবে নতুন দুর্নিতির চুক্তি। যে চুক্তিতে ধর্ষিত হবে আমার স্বাধীন দেশ বছরের পর বছর। কে জানে কয়েক ঘন্টা আগে যে মুখে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মায়া কান্না, সেই মন্ত্রীর মন্ত্রানালয়ে মুক্তিযোদ্ধা গলাধাক্কা খেয়ে তার অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে।
কে জানে আজ যে নপুংশক কবিরা অসংখ্য কবিতার জন্ম দিবেন কাল তারা ২০ টাকা ঘুষ দিয়ে ট্রেনের টিকিট কিনবেন! আর শুকরের মত ঘোৎ ঘোৎ করে বলবেন "শালার দেশে ঘুষ ছাড়া কিছু হয় না!" কে জানে আমাদের কবিরা কদম ফুল কল্পনা করেন শুধু বর্ষার প্রথম দিনে। শরতের মেঘের তুলনা ভাসলে কাঁশফুলও যে দোলেনা তাদের মনে! এই অশ্লীল কবিরা তিন মাস লেখেন আদিরসের কবিতা, দুমাস লেখে বর্ষার কবিতা। আর চারমাস ব্যস্ত থাকেন তোষামুদি কবিতা লিখতে। হায় মুক্তিযুদ্ধ! হায় মুক্তিযোদ্ধা, হায় অভাগা শহীদ! তোমাদের জন্য কবিরা দয়া করে বরাদ্দ করেছেন একটি দিন! ১৬ ডিসেম্বার! অশ্লীল হাজারো কবিতা দেখা যাবে পত্রিকা,দেয়াল আর ব্লগ, ফেইসবুক, টুইটার।
আর যখন দেখতে পাই বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়া ক্রেস্টের সোনা চুরি সাথে জরিত আমাদের স্বয়ং মন্ত্রী। তখন উনাদের লজ্জা না হলেও আমি লজ্জিত হই।খুব জানতে ইচ্ছে করে কলেজিয়েট স্কুলের দশম শ্রেনীর ছাত্রটি বুকে গুলি খেয়ে মরে পড়েছিলো কোন জলাভূমিতে? যে গুলিটি সে বুক দিয়ে ঠেকিয়েছে, মায়ের গায়ে লাগতে দেয়নি। কেমন আছে সে! ভাই, তুমি কি দেখতে পাচ্ছো তোমাদের নিয়ে বিজয় দিবসে কত বড় নাটক মঞ্চায়িত হচ্ছে দেশে! তোমার মা কতো বছর ভাত খায় না কারন তুমি ছেলে মৃত্যুর আগে ভাত খেতে চেয়েছিলে। তোমার মা আজও মাটিতে ঘুমান ;কারন তুমি ছেলে শক্ত মেঝেতে পড়েছিলে মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত। তোমার মা আজ ছেড়া স্যান্ডেল পড়ে সংয়ের মত বসে থাকে সেমিনারে আর ভন্ডের দল বক্তৃতা দিয়ে যায় ঘন্টার পর ঘন্টা।
আর কত অশ্লীল নাটক দেখতে হবে বিজয় দিবস নিয়ে! আর কত তামাশা! কেন মঞ্চ ভেঙ্গে পড়ে না! কেন নপুংসক কবিদের কবিতা ধুয়ে যায় না শহীদের রক্তে! আর কত অশ্লীল নৃত্য দেখবো এই বিজয় দিবসে! যারা এই মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ব্যবসা করছে আর করছে ধিক্কার জানাই আর হৃদয়ের সকল আবেগ মিশ্রিত কন্ঠ গাইবো এই গান-
"হয়তোবা ইতিহাসে তোমাদের নাম লিখা,
রবেনা বড় বড় মানুষের ভিড়ে।
জ্ঞানী আর গুনীদের আসরে,
তোমাদের কথা কেউ কবে না।
তবু হে বিজয়ী বীর মুক্তি সেনা,
তোমাদের এই ঋন কোনদিন শোধ হবে না।"
রবেনা বড় বড় মানুষের ভিড়ে।
জ্ঞানী আর গুনীদের আসরে,
তোমাদের কথা কেউ কবে না।
তবু হে বিজয়ী বীর মুক্তি সেনা,
তোমাদের এই ঋন কোনদিন শোধ হবে না।"