অনেকদিন
ধরে বোয়ালমাছ খাবার বায়না ধরেছে মিনু, ও চারমাসের অন্তঃসত্ত্বা । আজ চলতি মাসের একুশ তারিখ । হাতের অবস্থা বড়ই নাজুক । মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, বেতন হাতে পেলে তুমি যা-যা খেতে চাও? সব এনে দিবো ,চিন্তা করো না। ‘এখন খাবার দাও ?' আমার অফিসে যাবার সময় হলো । ভিলেন মার্কা অভদ্র একজন অফিসার আছে ,সবসময় মানুষের পিছনে একটা পিন বিধিয়ে দেবার পায়তারা চলে অবিরাম ।‘কাকে কি ভাবে পিন দিবে !'আস্তাগফিরুল্লাহ মানুষ কী তাই এত খারাপ হয় । এ অফিসে চাকরি না হলে হয়তো বুঝতাম না ।সকালে বউ রসুনের পাতা দিয়ে টমেটো ভর্তা করেছে ,আহা কি স্বাদ ।গরম ভাতের সঙ্গে হালকা একটু বলরাম কাকার হাতের তৈরিকরা ঘি, ঢেলে নিলাম ।স্বাদ দ্বিগুণ বেড়ে-গেল ।বউ আমার পিছনে দাঁড়িয়ে বলছে,
- এই শুনছো,
-হ্যাঁ বল,
-আমাদের তো একদিনও চিড়িয়াখানা নিয়ে গেলে না । এ সময় চিড়িয়াখানা যেতে নেই । লোকমুখে শুনেছি , ছেলেমেয়ে দেখতে না-কি বানরের মত হয় । ও আল্লাহ্ তুমি এসব কি বলও ।হুম সত্যি বলছি গো বউ ।তা না হলে তোমাকে নিয়ে যাবো না কেন ? তুমি আমার একমাত্র আদরের লক্ষিসোনা বউ । আমার খাওয়া শেষ, বউয়ের শাড়ির আঁচল দিয়ে হাত মুছে খাঁটের উপর বসলাম । বউ আমার শরীর ঘেঁসে বসলো । আচ্ছা তুমি এত তাড়াতাড়ি অফিসে যাচ্ছো কেন ? তাড়াতাড়ি মানে, বেলা ন'টা বাজতে চললো । আমরা তো আর সরকারি অফিসে চাকরি করিনা । বেলা বারটার সময় গেলেও সমস্যা নেই ।" কোম্পানির চাকরি এক টাকার ভিতর থেকে ষোল টাকা বের করে । অনেক -ই আছে , রসুনের চোচা ভাজি করে খায় ।"
অফিসে শেষে বাসায় ফিরতে আমার একটু দেরি হলেই, ফোন । তুমি এখনো আসছো না কেন ?' কলিঙদের সঙ্গে আড্ডা বাদ দিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে চলা সেই পুরাতন পথ ধরে ।অলিগলি পার হয়েই যখন বাসার খুব কাছে যাই, হাতে করে বউ,বাচ্চার জন্য কিছুই নিয়ে যেতে পারিনা । মাস শেষে সংসারের খরচ, নিজের ওষুধ ,মিনুর ওষুধ বাসা-ভাড়া ,বাজার এ সব শেষ করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে ।এখানে পানি পর্যন্ত কিনে খেতে হয় । এর নাম আজব শহর ঢাকা । আহা রে ! আগে মনে করতাম ঢাকা মানেই সুখের নগরী । এখন মনে হয়ে এ নগর থেকে দূরে সরে থাকাই ভাল । ভয়ে পরিচিত কারও কাছে বাসার ঠিকানা দেইনা । বাসায় একজনকে নিয়ে এসে কি খেতে দিবো ।এত টানাটানির ভিতর সংসার করতে হচ্ছে । এইট পাশ মানুষ এই ডিজিটাল যুগে কত টাকার বেতনে চাকরি করবে ! কত টাকা হলে যমুনা ফিউচার পার্কে সিনে কমপ্লেক্স বাংলা সিনেমা দেখতে যাওয়া হবে । বউ খুব আহ্লাদ করে একদিন বলেছিল, এই তুমি না আগে বলতে, 'ঢাকা নিয়ে গেলে আমাকে বড় পর্দায় সিনেমা দেখাবে মিথ্যাবাদী '। আমাকে তো সিনেমা দেখাতে নিলে না । সিনেমা দেখতে হয়না । আল্লাহ্ গুণা দিবে । মিনুকে জীবনে কত গুলো মিথ্যা কথা বলেছি , শুধু মাত্র অভাবে পরে, মা বলতো ,বাজান রে! কখনো মিথ্যা কথা বলিস না । মা'দুটি মিথ্যা কথা বলি বলেই সুখে সংসার করছি ।
ডাক্তার দেখানোর পর,একটা ধাক্কা খেলাম ।পুষ্টি হীনতায় ভুগছে , তার পরে মিনুর প্রস্রাবে ইনফেকশন ।পায়ে পানি লেগে গেছে ।ডাক্তার ফুল বেড রেস্ট থাকতে বলেছে । পেটের বাচ্চার উপর বিশেষ একটা প্রভাব পড়বে তা, শুনার পর মনটা খারাপ হয়ে গেল । শাক সবজি,ফলমূল তেমন খাওয়ানো হয়নি ।তার পরে যে বিষয়টা সব চেয়ে বেশি সমস্যা হয়েছে,' অল্প বয়সে মা হওয়াটা '।বড় আপা বলেছিল__, অল্প বয়সী মেয়েকে বিয়ে না করতে গ্রামের লোকজন বন্ধু অনেক-ই বলেছিল না করতে , কিন্তু পরিবেশটা এমন হয়েছিল সেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব হয়নি । মিনুরা গরীব মানুষ , অসহায় পরিবার । বাবা নেই, মা দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। মামার বাড়ি থেকে লেখাপড়া কোন মত বিয়ে দিতে পারলে তাঁরা একটা নিঃশ্বাস নিতে পারে ।এমন একটা পর্যায়ে চলে আসছিল তখন আমি নিজেই জানার পরেও একটা ভুল করলাম ।
দ্বিতীয় ভুল হয়েছিল, মিনুর পেটে যখন সন্তান আসে ।তখন আমি চেয়েছিলাম, ওকে দুনিয়াতে না আনতে , এ কথা মা' শুনে, আমাকে প্রচণ্ড বকাবাজি করেছে । এক পর্যায়ে আমাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলছে ।' এমন পাপ কাজ করতে তোর লজ্জা করে না হারামজাদা'।বংশের আলো আসছে আর তুই তা নিভিয়ে দিতে চাস পাজি কোথাকার । খবরদার আমার সামনে আসবি না কিন্তু ? মায়ের কড়া শাসন । আমি লজ্জায় ঘর থেকে বের হয়ে চলে আসলাম সেদিন । কি সব গাছারা ওষুধ খেয়েছিল মিনু ।
পরিবারের কথা শুনে পরে বুঝলাম সত্যি অল্প বয়সী মেয়েকে বিয়ে করা ঠিক হয়নি ।এটা মারাক্তক ভুল অপরাধ ও বটে।ভুয়া জন্ম নিবন্ধন নিয়ে মিনুর বিয়ে হয় । মিনুর বয়স তখন ষোল বছর ।কলেজে পড়ে । এখনো কোন কোন গ্রামে ষোল বছর বয়স মানে অনেক বয়স । মেয়ে মানুষ ঘরে রাখলে খারাপ হয়ে যাবে, পরে আর বিয়ে হবে না । চেহারা নষ্ট হয়ে যাবে । কত ধরণের কিচ্ছাকাহিনি শুনতে হয়েছে, মিনুর ।চোখ গড়িয়ে জল পড়তেই আমার চোখ চলে গেল মিনুর দিকে । আহারে ! বিচারি । এখন ওর মনে হচ্ছে হয়তো মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়াটা ওর একটা অভিশাপ ।
আমি মিনুর পাশে গিয়ে বসলাম,সুদীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আমাকে বলছে, আমার উপর কি তুমি রাগ করে আছো । ধূর পাগলী বউয়ের উপর রাগ করতে নেই । আমি মৃদু হেঁসে ওর হাতের সঙ্গে আমার অপারগ আঙুল দিয়ে স্পর্শ করলাম,পুলকিত হল ।এ সময় মেয়েরা একটু ভালবাসা চায় , সহানুভূতি পেতে ভাল লাগে ।এ সময় বাঙালি মেয়েরা সাধারণত মায়ের বাড়িতে থাকে । আমিও মনে মনে ভাবছি, ওকে কিছুদিন পর রাজবাড়ি পাঠিয়ে দিবো । আমাকে বলছে, তুমি কিন্তু আমার সঙ্গে থাকবে । আমাদের যেদিন সন্তান হবে সেদিন তুমি আমার পাশে থাকবে । আমার প্রচণ্ড ভয় করে । আমি ঠোঁটের কিনারে হালকা হাসি মেখে বললাম, আমি থাকলে তোমার ভয় করবে না । গৃহপাতালক শিশু বাচ্চার মত জবাব দিল না ।বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরতেই মনে হলো আমার অপূর্ণতা দূরে চলে গেল ।
রাতে শাশুড়ি ফোন দিয়ে বললো...
-বাবা, মিনুর, অবস্থা খুব বেশি ভালো না । তুমি দ্রুত রওনা দাও । আমি ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, এখনো ন'দিন বাকি ডাক্তার যে তারিখ দিয়েছিল..,
আমি রাতেই রওনা হলাম ।বাসা থেকে অনেক দূর চলে এসেছি , পকেটে হাত দিয়ে বুঝতে পারলাম মোবাইল ফোন ভুলে রেখে এসেছি । আবার ফিরে গেলাম । মোবাইল নিয়ে আসবার পথে অজ্ঞাত নম্বর থেকে কল । হ্যাঁ বলতেই ওপাশ থেকে ভিজা কণ্ঠে কান্নার আওয়াজ মনভার হয়ে গেল। আমি বোকা মানাব পরিণত হলাম।কিছুই বুঝে ওঠতে পারছি না । ভোরে হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমার চোখ ভিজে ঝাপসা হয়ে ওঠছে, শাশুড়ি আমাকে ভিতরে আসতে বললো । অপারেশন থিয়েটার থেকে মিনুকে বের করে নিয়ে আসছে ।সাদা ফ্যাঁকাসে দেখাচ্ছে ।এত মায়া হচ্ছিল ।মনে হচ্ছে মিনুকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখি । ডাক্তার জানিয়ে দিল ।
-বাচ্চা ও মাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি । আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম ।ভিতর থেকে পোড়া বারুদের গন্ধ বের হতে লাগলো নিজেকে পোড়া ধূপ শিখার মত মনে হতে লাগলো...!
ঘরে এলইডি বাল্ব লাগানো তবুও অন্ধকার লাগছে আমার কাছে , ছোট একটা রুম দুটি বাতি জ্বলছে তবুও কত অন্ধকার ।এ ঘরে বাতি না জ্বালালেও আলোকময় হয়ে থাকতো সব সময় ।মিনু ছিল আমার জীবনে একটি আলোকিত বাতির মত । আজ সংসারে অভাব নেই । মানিব্যাগের কোনায় টাকা ভর্তি বোয়ালমাছ কিনতে চাইলেই পারি!
‘আমাকে কতদিন ধরে বলেছিল বোয়ালমাছ খাবে ।মাটির নিচে রান্নাকরা বোয়াল মাছের তরকারির ঘ্রাণ কি আজ মিনু পাবে !’
ছয়-নয় ভাবতেই, পিছন থেকে আমার শাশুড়ি আমাকে ডাকছে,অশ্রু ভেজা চোখে আনান্দের ঢেউ এসে পড়লো...
-মিনু মরেনি !
আমি বিস্ময়কর দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম , বুঝে ওঠতে পারছি না কি বলবো । চারিদিকে মৃদু বাতাস , পরিবেশ কেমন শান্ত হয়ে গেল । তারকারাজি আকাশ থেকে নৃত্যময় অবস্থায় নেমে আসছে, আমাকে প্রেমময় চাঁদ আলিঙ্গন করছে । আমি তার বুকে নতজানু হয়ে ঘাপটি মেরে শুয়ে রইলাম ! ।‘আত্মা বেঁচে থাকে মানুষের মত একটি রূপ নিয়ে অনন্তকাল ।'