শুক্রবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

ঈদ আনন্দ উৎসবেও কেন এত বিভক্তি?

উৎসবপ্রিয় জাতি হিসেবে বাঙালির খ্যাতি ও ঐতিহ্য আছে বিশ্বসমাজে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের উৎসবগুলো আমরা ঘটা করেই পালন করে থাকি। উৎসব পালনের ক্ষেত্রে বাঙালি খুবই আন্তরিক এবং উদার। এ উৎসব-প্রিয়তা আমাদের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে জাতীয়জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, সমৃদ্ধ করেছে ধর্মীয় জীবনকেও।
পবিত্র ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা তেমনই উৎসব। এ উৎসবে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের অংশগ্রহণ করার কথা। পারি কি আমরা সবাই মিলে সেই আয়োজন করতে?

কেবল মাঠে-ময়দানে ঈদের জামাত যখন অনুষ্ঠিত হয়, তখন দেখি উঁচু-নিচু, ধনী-গরিব ভেদাভেদ ভুলে সবাই এক কাতারে মিলিত হয়ে নামাজ আদায় করেন। কিন্তু আজকাল সেখানেও ফারাক সৃষ্টি হয়েছে। প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী মানুষের কদর সেখানেও বেশি। তারা জামাতের সামনের সারিতে জায়গা পান।

 আবার জামাতে নামাজ পড়ার যে আয়োজন সেখানেও একটা বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। পোশাক-আশাক তো আছেই, কাতারবন্দি হওয়ার জন্য যখন সবাই একসঙ্গে দাঁড়ায়, তখন চোখে পড়ে ধনী-দরিদ্রের ফারাক ওই নামাজ পড়ার আসনটায়ও। ধনী বা সমর্থ মানুষ হাতে করে নিয়ে আসেন জায়নামাজ, নানান কিসিমের। তারা দাঁড়ান ওইসব পেতে আর দরিদ্র মানুষ নামাজ পড়েন চাটাইয়ের ওপর বিছিয়ে দেয়া ডেকোরেটরের কাপড়ে। এমন বৈষম্য সত্ত্বেও সবার মনেই আনন্দ থাকে, নিজের নিজের মনে করে।

যারা ধর্মচেতা তারাও এই দূরত্বটা দূর করার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। বরং বাড়িয়েছেন নানান অজুহাতে।

আপনি যখন ঈদের জামাতে যাওয়ার জন্য গাড়ি কিংবা রিকশা অথবা কাছে হলে বাচ্চাদের নিয়ে হেঁটেই মাঠে অথবা মসজিদে যান, তখন দেখা যায় মাঠে-মসজিদে ঢোকার আগে ছিন্নবসনে বহু নারী-পুরুষ হাত পেতে বসে থাকে ভিক্ষার আশায়! এ দৃশ্য ক্রমেই বাড়ছে। অথচ এরাও তো মানুষ, মুসলমান, এদেরও তো নামাজ আদায় করার কথা। কিন্তু আমরা প্রত্যক্ষ করি ভিন্ন দৃশ্য। প্রত্যেক পরবেই এমন দৃশ্য দেখে অনুতপ্ত হই কি না জানি না। অনেকে হয়তো বলবেন, আমাদের তো সমাজ-শ্রেণি বিভক্ত, এমন তো হবেই। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন, কেন এমন হবে? ধর্মাচার মেনে চললে কি এমন বৈষম্য থাকার কথা?

 অথবা মানুষকে মানুষ ভাবলে অন্তত একটা দিনে কিছু সময়ের জন্য কি আমরা মানুষকে ধর্মপ্রাণ মুসলিম ভাবতে পারতাম না? তাই কথায় ও কাজে ধর্ম ব্যবহার করাটাই সবার না হলেও অনেকেরই কামনা। এই ভেবে সান্তনা পাই, আমাদের সমাজটা তো নানা শ্রেণিতে বিভক্ত, তা যদি না হতো তবে ধনী-দরিদ্র থাকত না, ফিতরা দেয়ার বিধান থাকত না।

তাই তো শ্রেণিবিভক্ত সমাজে নানা বৈষম্য এবং অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়গুলো প্রকট হয়ে ওঠে। জামাতের কথা ছেড়ে দিলাম। বাড়িতে, ঘরে ঘরে যে পোলাও-কোরমা, কালিয়া-কোপ্তা, জর্দা-সেমাই, দই-পায়েশ-ফিরনি কত না পদের রান্না হয়। এমন তালিকাভুক্ত খাবারের পরিবেশনা বড়লোকদের বাড়িতে বিস্তর থাকে।

শ্রেণিবিন্যাসের কারণে সাধ্যমতো আয়োজন করে মধ্যবিত্ত জনগণও। কিন্তু কী হয় গরিব ঘরে? কোনোরকমে হয়তো ধর্মাচার মানা ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না। তবে বোনাসের বিধান যাদের ভাগ্যে জোটে তারা কেবল স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে কিছুটা। ভাগ্যিস এ বিধানটা প্রবর্তিত হয়েছিল। না হলে অভুক্ত থাকতে হতো বহুজনকেই। আতর-সুরমা, সুগন্ধি মাখার জৌলুস বাদে চোগা-চাপকান, নতুন পায়জামা-পাঞ্জাবি (বাহারি), নতুন জুতা-টুপি, নানা রঙ ও রুচির কি উঠত শরীরে? পুরনো লুঙ্গি আর কোনো দয়ালু বড়লোকের দেয়া পাঞ্জাবি, পুরনো হলেও চাপিয়ে কত যে মানুষ চলেন সমাজে, এই ঈদের আনন্দোৎসবে, তা কি আমরা খেয়াল করে দেখেছি?

 আমাদের মধ্যেই আছেন এমন অসংখ্য মানুষ, যারা কালোবাজারি, চোরাচালানি, ঘুষ-দুর্নীতি কিংবা গরিবের কাঁধে চড়ে মুনাফা লোটেন, সেসব অর্থবিত্ত গোষ্ঠীর কৃপা হয় অসময়ে দান-খয়রাতের।

অথচ খোঁজ নিলে দেখা যাবে এদের মধ্যে যারা শিল্পপতি মালদার আদমি তারা নিজের প্রতিষ্ঠানেই হয়তো সময়মতো শ্রমিকের টাকা-পয়সা পরিশোধ করেননি। অথচ এদিকে সোয়াব কামানোর কৌশল অবলম্বন করছেন।

লেখক :মোঃ মেহেদী হাসান।
সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
Share: