
ধরাবাঁধা নীতি শাস্ত্র কচলাতে কচলাতে মানুষ তাঁর মানবতা-বোধকে লিঙ্গ, ধর্ম, দেশ, গোত্র, জন্ম পরিচয়ের অভ্যন্তরে গৃহবন্দী করে ফেলেছে। তাই সে, নারীবাদী কিংবা পুরুষ-তন্ত্র দৃষ্টিকোণ থেকে মানবতা বোধকে একচেটিয়া অধিকার মনে করে। কতটা এন্টি-পলিটিকাল আর কতটা এন্টি সোশ্যাল প্রচারণা দিয়ে নারীবাদী কিংবা পুরুষ-তন্ত্র জিইয়ে রেখে রাজনীতি হয়, ব্যবসা হয়, সামাজিক পদ মর্যাদায় আস্ফালন করা করা যায়, কিন্তু পীড়িত মানুষের জন্য মানবতা বোধ জাগ্রত হয় না। যারা বলে, মিথ্যে বলে। মতবাদের ফেরিওয়ালা, লোক দেখানো সার্কাস করে, ঝোপ বুঝে কোপ মারে, এইসব মতবাদ, নব্য মতবাদের ফেরিওয়ালারা ঠিক মানুষের মনের কথা জানে, আম-জনতার ভেড়ার পাল কোন দিকে যাবে। কী পেলে খুশি হবে, আবেগ তাড়িত করে ধরাশায়ী করা যাবে। মোল্লা-তন্ত্র বলো, মুক্তমনা বলো, মানবতা-বোধ বলো, নারীবাদী কিংবা পুরুষ-তন্ত্র বলো, মুক্তবাজার নীতিতে এখন এমন সব অখাদ্যও বিক্রি হয়, কেউ ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে নয়। পার্থক্য শুধু কেউ নাম চায়, কেউ দাম চায়। সম-চাহিদা থেকে কারও নাম এবং দামের চেয়ে খ্যাতির বিরম্ভনা আরও বেশি, সুদের লাভ অংশ পিপড়াও বোঝে, শুধু বোঝে না আম-জনতার ভেড়ার পাল।
নারীবাদ থেকে মানবতা-বোধ কতোটা দূর? কিংবা পুরুষ-তন্ত্র থেকে মানবতা-বোধ? মানবতা-বোধ কী নারী পুরুষের লিঙ্গ দ্বারা বিভাজন? যদি তাঁর উত্তর হয়, না। তবে ধরে নিতে পারি, মানুষ মাত্রে’ই মানবিক মূল্যবোধ সম্পূর্ণ মানুষ। এবং সেই সৎ বিবেকবান মানুষের জন্য শ্রেয় এবং শ্রেষ্ঠতম পৃথিবীর সন্তান। তাঁর কোনো লিঙ্গ পরিচয় নাই, ধর্ম পরিচয় নাই, দেশ, গোত্র পরিচয় নাই, জন্ম পরিচয় নাই, একদিন হয়তো লিঙ্গ, ধর্ম, দেশ, গোত্র, জন্ম পরিচয় ছেড়ে মানুষের পরিচয় হবে, শুধুই মানুষ। এবং মানবতা-বোধেই হবে, তাঁর জীবনের ব্রত এবং শ্রেষ্ঠ ধর্ম। মানুষের বংশ বৃদ্ধির জন্য সে ব্যক্তিগত সম্পদ রক্ষা এবং ধর্ম, দেশ, গোত্র, জন্ম পরিচয়ের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে না।
এক পৃথিবী, এক মানুষ, এক তাঁর মানবতা-বোধ। অতিকথন প্রতি হিংসাপরায়ণ, চৌর্যবৃত্তি কৌশল যেমন ব্যক্তির জন্য ক্ষতিকর। ঠিক তেমনি, লিঙ্গ, ধর্ম, দেশ, গোত্র, জন্ম পরিচয়ের অতিকথন চৌর্যবৃত্তি কৌশল মানবতা-বোধের জন্য একই রকম ভাবে ক্ষতিকর। লিঙ্গ, ধর্ম, দেশ, গোত্র, জন্ম পরিচয়ের অন্তরালে তখন মানবতা-বোধ নব জাতক শিশুর মত ডুকরে কেঁদে উঠে। মানুষের মন সংবেদনশীল, সব সময় যুক্তি তর্কের শিরোনামে অবতারণা করে না। তাঁর, লিঙ্গ, ধর্ম, দেশ, গোত্র, জন্ম পরিচয় বিবেচ্য বিষয় নয়, সে মানুষ, এই বিবেচনা বোধেই একজন মানুষকে, প্রতারিত, বঞ্চিত মানুষটার প্রতি বিবেক তাকে প্ররোচিত করে। জাগ্রত বিবেক স্থান কাল, পাত্র, দেখে না। সে সর্বদাই জাগ্রত, সবার প্রতিই তার সমান দৃষ্টি ভঙ্গি সমান। তাকে শুধু লিঙ্গ, ধর্ম, দেশ, গোত্র, জন্ম পরিচয় দিয়ে বিচার করার অবকাশ নাই।
আম-জনতা চিরকালেই আম-জনতা। মানুষ বলতে, নারী, পুরুষ বুঝে, ধর্ম বলতে, মুসলমান, হিন্দু….বোঝে। দেশ বলতে, ভূখণ্ড বোঝে, গোত্র বলতে, বংশ মর্যাদা বোঝে, জন্ম পরিচয় বলতে, পিতৃ পরিচয় বোঝে, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। শুধু মানুষ বলতে, আপাদমস্তক মানুষ বোঝে না। বোঝে, সমগোত্রীয়, সম-দেশীয়, সম মর্যাদা সম্পন্ন না হলে, সে বুঝি, আর মানুষের কাতারের হিসাবের মধ্যে পড়ে না? বিভাজন সৃষ্টিকারী এইসব মতবাদ, নব্য মতবাদের ফেরিওয়ালার গালে কষিয়ে ঠিক থাপ্পড় মারো, নিজের মহামূল্যবান আবেগ, বিবেক অন্যের ব্যবহারের বস্তু হিসাবে বিকিয়ে দিও না। নিজেকে প্রবোধ দাও, সব মতবাদ, উপ-মতবাদকে ছাড়িয়ে তুমি মানুষ, মানবতাই তোমার শ্রেষ্ঠ ধর্ম। আত্ম পরিচয় দেওয়ার জন্য তোমার একটি নামেই বহন করার যোগ্যতা, তুমি রাখো। বাকি সব, দুধের ধোয়া তুলসী পাতার মত, বানের জলে ভাসিয়ে দাও। একখণ্ড মসজিদ, মন্দিরের ইট-পোস্তরের চেয়ে তোমার ঐ তড়িৎ সূর্যের আলো আরও পাক-পবিত্র, আর বেশি সত্য।
আগাগোড়া আপাদমস্তক নিজেকে জানো, কতটুকু ত্যাগ করার মানসিকতা সহ্য করার ক্ষমতা আছে? কতটুকু বন্ধন মুক্ত জলের মত গড়িয়ে যেতে পারবে? শুধু জ্ঞানগর্ভ কথার ফুল ঝড়িয়ে উলু-বনে মুক্তা ছড়িয়ে ভাববাদী হওয়ার চেয়ে, বাস্তববাদী হওয়া ঢের বেশী আনন্দের, পাগলের সুখ মনে মনে, শুধু লোক নিন্দা পরচর্চার ভয়ে জীবন সংগ্রামের ময়দান থেকে পালিয়ে যেওনা। লোক নিন্দা পরচর্চার চেয়ে একটা জীবন বেচে থাকা অনেক মহামূল্যবান, জীবন সবাই’র কাছে প্রিয়। কেউ ভোগ বিলাস, আরাম আয়েশে, আর কেউ আত্ম ত্যাগে। যে, যেখানে জীবনের সার্থকতা খুঁজে পায়। তাতে অসন্তোষ হবার কিছু নাই, শুধু নিজে ভোগ বিলাস, আরাম আয়েশে বেচে থেকে, অন্যের বেচে থাকার ছোট ছোট আবেগ, ছোট ছোট ইচ্ছেকে পায়ের তলায় পিষে মেরে ফেলো না। তাতে শুধু তুমি আবেগকে মারো না, সাথে একজন মানুষকেও মারো। তাঁর সাথে মেরে ফেলো তোমার নিজের ভেতরের লালিত মানবতা-বোধকে। অনেক দিন আগে, বিরহ কাতর মন নিয়ে একজন সমুদ্রের জল দেখে তীরে আঁচড়ে পড়েছিল। বলেছিলাম, বাজার থেকে ফুল কিনে নিয়ে ফুলদানীতে সাজানোর নাম ভালোবাসা নয়, কলি থেকে ফুল হয়ে ফোটার নামেই ভালোবাসা। যে, মানুষ ফুল ভালোবাসে, সে একই মানুষ কেমন করে অন্য মানুষের প্রতি ঘৃণা ছুড়ে দিতে পারে? শুধু সমগোত্রীয়, সম-দেশীয়, সম মর্যাদা সম্পন্ন, সম-মতবাদ সম্পন্ন মানুষ না হওয়াটাই কী একজন মানুষের একটা অপরাধ হতে পারে?
মানবতার আবার পক্ষ-বিপক্ষ কী? সে তো সকল দেশের, সকল মানুষের, হাসি, কান্না, দুঃখ, কষ্টের যাতনা’র ভাষা তো পৃথিবীর সব মানুষের এক। তাকে কী লিঙ্গ, ধর্ম, দেশ, গোত্র, জন্ম দিয়ে নির্ধারণ করে দেওয়া যায়? সবার ভেতরেই ঈশ্বর ও শয়তান থাকেন, ভালো মন্দ দুটো দিকেই থাকে। অন্যের কথায় প্ররোচিত হওয়ার দরকার নেই। তুমি কোন দিক দিয়ে জীবনকে উজ্জীবিত করবে, নিজের অর্জিত শিক্ষা, রুচি, বিবেকের দ্বারস্থ হও। সিদ্ধান্ত নাও। স্বর্ণলতা পরজীবী লতার মত অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে বেচে থেকো না। বরং বৃক্ষের মত মাথা উঁচু করে স্ব সম্মানে স্বনির্ভর চিন্তার আত্ম মর্যাদাবোধের উপর দাড়িয়ে বেচে থাকো, কারণ তুমি মানুষ। প্রত্যেক মানুষেই তাঁর নিজের অবস্থানে ঠিক, তোমার কাছে যা ন্যায়, অন্যের কাছে তাই অন্যয়। শুধু মানবতাকে ন্যায়-অন্যায়ের বিচারে দণ্ডিত করতে যেওনা। মানুষ ও মানবিকতা তাঁর থেকেও আরও বেশি কিছু। যার কোনো ওজন, দর নেই। মানুষ ও মানবতার জয় একদিন হবেই। লিঙ্গ, ধর্ম, দেশ, গোত্র, জন্ম পরিচয়ের মত বিষয়গুলো নিক্ষিপ্ত হবে ঘোড়ার আস্তাবলে। কালের বিবর্তনে এটাই চির সত্য। কারণ সত্যের কোনো চিরস্থায়ী রূপ নেই। তা চিরকালেই গতিশীল, বিশ্বজনিন ,জয় হোক মানুষের, জয় হোক মানবতার।
মো :মেহেদী হাসান,
সহ:সম্পাদক ,
আলোকিত চুয়াডাঙ্গা।