আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ৫ জানুয়ারিকে স্মরণ করতে চাইছে ঘটা করে। বিপরীতমুখী অবস্থান দুই দলেরই। গণতন্ত্র উদ্ধার হত্যা দিবস আর গণতন্ত্র রক্ষা দিবসই প্রতিপাদ্য। খই ফুটিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনকে উত্তপ্ত করার আকাঙ্ক্ষা দুই দলেরই। টিভি ক্যামেরার সামনে দুই দলের নেতারা যখন ৫ জানুয়ারির ঘটনা বর্ণনা করেন তখন রিকশাওয়ালা আর ক্ষেতে কাজ করা মানুষটি মোটেও বিচলিত হয় না। নেতাদের মুখচ্ছবি টিভিতে দেখার পর সঙ্গত কারণেই একজন সাধারণ মানুষ ফ্ল্যাশব্যাকে তিন বছর আগের ৫ জানুয়ারির দৃশ্য কল্পনা করতে পারেন। ভাবতে পারেন ওইদিনের গণতন্ত্রটা কেমন ছিল। আর মাত্র তিনটি বছর আগে সেই গণতন্ত্রের চাপ তাকে কতটা সহ্য করতে হয়েছে।
বিএনপি যখন ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের কথা বলে শুরুতে হা করে তাকিয়ে থাকতে হয়। নির্বাকই। কারণ ঘটনা সত্য। কিন্তু যে মুহূর্তে বিএনপি আওয়ামী লীগকে ওইসময় গণতন্ত্র হত্যাকারী হিসেবে উল্লেখ করে এবং হৃত গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসেবে উদযাপনের কথা বলে, খুব হাসি পায়। বিতর্কিত নির্বাচন হয়েছে সন্দেহাতীত। আওয়ামী লীগ তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও এটা সত্য। আবার এও দেখা গেছে, বেগম খালেদা জিয়ার বাসার সামনে বালুর ট্রাক দাঁড়িয়ে গেছে অনড়। কিন্তু যখন দেখি বেগম জিয়াকে সমবেদনা জানানোর জন্য শেখ হাসিনা নিজে ছুটে যান খালেদা জিয়ার পুত্র হারানোর কারণে এবং তাকে ঢুকতে দেওয়া হয় না শুধুই কথিত গণতন্ত্রীয় জেদের জন্য। একটু হোঁচটতো খেতেই হয়। ব্যক্তিগত বিষয় বলে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। নেতাদের অনেক ব্যক্তিগত বিষয়ও যে গণতন্ত্রের রেখায় চলে আসে। আবার দুই নেত্রীর টেলিফোন সংলাপের ঐতিহাসিক দৃশ্যও কি ভুলে যাওয়ার মতো? সেটাওতো ওই সময়কার ঘটনারই একটি অংশমাত্র। কী ভয়ংকর ব্যাঘ্র হুংকার দেখেছি টেলিফোন সংলাপে। গণতন্ত্রটা যে হুংকারের তলে চাপা পড়ে গিয়েছিল।
নির্বাচন মাধ্যমে ক্ষমতার পালা বদলের কথা হচ্ছিল। যেখানে সবাই অংশগ্রহণ করবে। মিমাংসিত পদ্ধতিকে জটিল করে দিয়ে যে অগ্নি উৎসব করা হলো সারা বাংলায়, সেটাওতো কথিত গণতন্ত্রেরই প্রতীক। বাসে যাত্রী পুড়িয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে নগ্নরূপ এদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে, সেই গণতন্ত্রকেই কি আবার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে? তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল সেই অগ্নিসন্ত্রাসইতো দমন করেছিল। সেটা যদি হয় গণতন্ত্র হত্যা, তাহলে আর কী বলার আছে।
লক্ষণটা কেমন কেমন লাগছে। অগ্নিবিপ্লবকালে জামায়াতে ইসলামীর পাণ্ডারা মাঠে ছিল। হাতেনাতে ধরাও পড়েছে কিছু। তাদের তাণ্ডব যখন মানুষকে তটস্থ করে দিয়েছিল তখনই বোমার আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে একটা উচ্চারণ মানুষের কানে এসেছে- তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। এখনো কি সেই স্বপ্নই দেখা হচ্ছে?
এবছরও জামায়াতিদের উস্কে দেওয়ার জন্যই মনে হয়, বেগম খালেদা জিয়া হুংকার দিলেন- শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা দেননি। স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, জিয়াউর রহমান। এমন সময় তিনি এই হুংকার দিলেন যখন একজন এমপির গুলিবিদ্ধ লাশ দেখেছে মানুষ। খুলনায় পথচারীর ওপর গুলি হয়েছে। তার আগে হলি আর্টিজান, শোলাকিয়ায় ঈদের জামায়াতের কাছে গুলিসহ নানা ঘটনাক্রম চোখে পড়েছে। তারই ধারাবাহিকতায়ই কি তারা ডাক দিলেন ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা দিবস পালন করবেন?
আর আওয়ামী লীগও বলে দিলো তারা পালন করবে গণতন্ত্র দিবস। দিবসটিকে গুরুত্ববহ করে দিলো একইদিনে নারায়ণগঞ্জে নবনির্বাচিত সিটি কর্পোরেশন মেয়র ও কাউন্সিলরদের শপথ গ্রহণের কর্মসূচি। যে নির্বাচনকে আবার বিএনপিই সুষ্ঠু বলে মেনে নিয়েছে সর্বাংশে। এদিকে উভয়ই ঘোষণা দিল তারা সমাবেশ করবে ৫ জানুয়ারি। যেমনটা তিন বছর আগে আমরা দেখতাম এই দেশে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দেওয়ার মধ্য দিয়ে।
এরমধ্যে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হলো, তারা বিএনপির কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে দেবে না। যুক্তি হিসেবে দেখালো- ৫ জানুয়ারি মনে করিয়ে দেয় অগ্নিসন্ত্রাসের কথা। সুতরাং ওরা যদি এই দিবস পালন করে তাহলে মনে করতে হবে আবারো অগ্নিসন্ত্রাস চালু হোক এটা বিএনপি চায়। আর গণস্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টাই হবে ওই অগ্নিসন্ত্রাসকে।
মাহবুব আলম হানিফের একটি ধমক হোক আর অগ্নিসন্ত্রাস নির্মূলে সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপের স্মৃতির কারণেই হোক বিএনপি’র হাঁকডাক অনেকটা ঝিমিয়ে গেছে ইতোমধ্যে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ওয়ার্ড পর্যায়ে সভা করে ৫ জানুয়ারির সমাবেশকে মহাসমাবেশে রূপান্তরের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তারা এটাও বলছে- বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি এখন শূন্যের দিকে। তাদের পক্ষে আন্দোলন করা আর সম্ভব নয়। এটা আওয়ামী লীগের দম্ভোক্তি কিনা জানি না। তবে শতভাগ মিথ্যা এমনটাও বলার সুযোগ নেই। কারণ একটি ইস্যুভিত্তিক সমাবেশ করতে হলে যে সাংগঠনিক কর্মসূচি আগে থেকে করতে হয় সেই কাজটি কিন্তু বিএনপি করছে না। তাদের বক্তব্য শুধু টিভি ক্যামেরার মধ্যে আটকে আছে। সুতরাং আওয়ামী লীগই যে শুধু সমাবেশ করতে পারবে এটা মনে হতে শুরু করেছে।
এক্ষেত্রে বিএনপি যদি বলে তাদের সমাবেশ করার অনুমতিই দিচ্ছে না সরকার। তখনও কিন্তু কথা থেকে যায়, মাঠে সমাবেশ করতে না দিলে বিকল্প কিছু করার নেই তাদের? এই প্রসঙ্গে বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। জিয়াউর রহমান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও তার আগে ডেপুটি সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে যখন অন্যদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে নিজে হেলিকপ্টারে চড়ে সারাদেশ চষে বেড়াচ্ছিলেন, ওই মুহূর্তে অন্যদলগুলো নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ঘরের ভিতরে থেকে রাজনীতি করতে থাকে। মনে থাকার কথা- ওই সূত্রে একসময় পত্রিকাগুলো তাদের এক চতুর্থাংশ সেই ঘরোয়া রাজনীতির সংবাদ প্রচারে অনুমতিও আদায় করে নেয় সামরিক সরকারের কাছ থেকে। এটা কিন্তু হয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলোর ভয়হীন পরিকল্পনার কারণে। সামরিক সরকারও বুঝতে পেরেছিল, ঘরের রাজনীতি বন্ধ করা হলে তার পরিণতি ভালো হবে না।
বিএনপির সেই অভিজ্ঞতা কি তারা ব্যবহার করতে পারে না? ৫ জানুয়ারি পালন বিষয়ে এটা বলছি। মনে হচ্ছে, তারা বড় সমাবেশেই উৎসাহী। সমাবেশের অধিকার না পেলে বিকল্প কিছু করার ক্ষমতা তাদের নেই এটাই প্রমান হয়ে যাচ্ছে। যদি বলা হয় নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রকাশ না করে তারা শুধু সমাবেশের কথাকেই জোর দিচ্ছে, তাও কি অসত্য বলে গণ্য হবে? নাকি নৈতিকভাবে গণতন্ত্র হত্যা দিবস উদযাপন করা সম্ভব হবে না বলে তারা একটা খোঁচা দিয়ে চুপসে গেছে। যাতে পরবর্তীকালে তারা বলতে পারে, আওয়ামী লীগ তাদের সমাবেশ করার অনুমতি দেয়নি। যেমনটা গত সময়ও তারা বলেছে এবং এখনো সেটাই বলে আসছে। কিন্তু মানুষ তাদের কথা কি শুনছে? তিন বছর ধরে তারা বলে আসছে দেড় শতাধিক এমপি বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় পাস করেছে, এই নির্বাচন মানি না। মানুষ কিন্তু মেনে নিয়েছে। সেই সরকার এখনো ক্ষমতাসীন। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে তাদের ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার মতো শক্তিও বিএনপির এখন নেই। শুধু জনগণ তাদের গ্রহণ করেনি বলেই। এখন তারা ৫ জানুয়ারিকে গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠার যে চেষ্টা চালাচ্ছে সেটাও যে একইভাবে জনগণ গ্রহণ করবে না এটাও প্রায় নিশ্চিত।
মোস্তফা হোসেইন : সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।
mhussain_71@yahoo.com