শনিবার, ৭ জানুয়ারী, ২০১৭

ওড়না বিতর্ক কতটা জরুরি?

আমীন আল রশীদ
আমীন আল রশীদ
আমার মেয়ের বয়স দুই বছর হবে আগামী ২২ জানুয়ারি। তার মা যেসব পোশাক পরেন, তার অনেকগুলোরই নাম সে বলতে পারে। যেমন জামাকে সে ‘দামা’ বলে, প্যান্টকে ‘প্যান্ত’। একইভাবে ওড়নাকে সে ওড়নাই বলে।  স্কুলে যাওয়ার আগেই সে ঘরের এসব নিত্যদেখা জিনিসের নাম জেনে যাচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, প্রথম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে এই ‘ওড়না’ শব্দটির ব্যবহার নিয়ে একটা বড় ধরনের ক্যাচাল তৈরি হয়েছে।

কয়েকদিন আগে যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হয়েছে সেখানে প্রথম শ্রেণির বাংলা বইতে ‘ও’ বর্ণটি দিয়ে ‘ওড়না’ পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে বেশ তোলপাড় শুরু হয়। যারা এই শব্দটি ব্যবহারের বিরোধী তারা মনে করেন, ওড়না শব্দটি ব্যবহারের মাধ্যমে একটি জেন্ডার বৈষম্য প্রকাশ পেয়েছে। তাদের যুক্তি, প্রথম শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থীর বয়স অনুযায়ী এ শব্দটি যথাযথ হয়নি। একধরনের সংকীর্ণ মানসিকতা থেকে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে বলেও কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন।
প্রশ্নটা এ কারণে যে, একজন ছেলেশিশুর জন্য ‘ও-তে ওড়না চাই’ বাক্যটি কতটা জরুরি? ওড়না যেহেতু মেয়েদের পোশাক হিসেবেই ব্যবহৃত, সুতরাং প্রাথমিকের একটি ছেলেশিশুর কাছে এটি প্রাসঙ্গিক নয়। তবে পাল্টা প্রশ্নও করা যায় এভাবে যে, ওড়না কি অশ্লীল শব্দ? তাছাড়া বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তৃতীয় শ্রেণি থেকেই স্কুলের ইউনিফর্মের অংশ হিসেবে মেয়েদের ওড়না পরতে হয়। এখানে লিঙ্গবৈষম্যের কোনো ব্যাপার নেই। পুরুষ এবং নারীর মধ্যে শারীরিক যেমন কিছু চিরায়ত পার্থক্য রয়েছে, তেমনি হাজার বছর ধরে পোশাকেও কিছু ভিন্নতা রয়েছে। কাল থেকে পৃথিবীর সব নারী-পুরুষ যদি একই পোশাক পরা শুরু করেন, তাহলে পৃথিবীর চেহারাটা কী দাঁড়াবে? সুতরাং দুই ক্লাস আগেই যদি একটি মেয়েশিশু ওড়না শব্দটি জানে, তাতে কী এমন ধর্মনিরপেক্ষতা বা নারী-স্বাধীনতার ক্ষতি হলো, তা পরিস্কার নয়।
ওড়নাকে স্রেফ একটি পোশাক হিসেবে দেখলে আর কোনো সমস্যা থাকে না। তাছাড়া বাংলাদেশের সামজিক বাস্তবতায় ওড়না শালিনতারও নির্দেশক। কাল থেকে যদি দেশের সব নারী ওড়না পরা বন্ধ করে দেন, সেই দৃশ্য দেখার জন্য কতজন প্রস্তুত আছেন? আবার ওড়না শুধু মেয়েরাই পরে, ব্যাপারটা এমন নয়। বরং ওড়নাসদৃশ একধরনের পোশাক ‘উত্তরীয়’, যা এই উপমহাদেশের পুরুষেরা পরিধান করেন এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই ওড়না বা উত্তরীয় পরিয়ে দেয়া একটা সম্মানেরও ব্যাপার। কিন্তু ওড়না নিয়ে এই বিতর্কের মূল কারণ হলো, অনেকে মনে করেন ওড়না ইসলামি পোশাক। বাস্তবতা হলো নারীর ইসলামি পোশাক বলতে বোঝায় বোরকা বা হিজাবকে। ওড়নার সঙ্গে ইসলামি আদর্শের কোনো সম্পর্ক নেই।
কারো কারো মতে, প্রথম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে ‘ও’ বর্ণ দিয়ে ‘ওলকপি’ বা ‘ওলকচু’ বা এরকম কোনো শব্দ লিখলে ভালো হত। কিন্তু শিশুকালে আপনি যদি আপনার সন্তানকে ‘ওড়না’ শব্দটি পড়াতে না চান, তাহলে ওলকচুরমতো একটা গলা চুলকানো সবজির নামই বা শেখাতে হবে কেন? ও দিয়ে আর কোনো শব্দ নেই? ও দিয়ে ওড়না বা ওলকচুর বিকল্প অনেক শব্দ লেখা যায় এবং সেটি ছড়ায় ছড়ায় বলা যায়, যেমন ওজন : ওজন করো সঠিক মাপে; ওড়া: ধানের খেতে ওই পাখিদের ওড়াউড়ি; ওমলেট: ডিমের ওমলেট ভারি মজা; ওষুধ: অসুখ হলে ওষুধ খাও ইত্যাদি।
তবে ওতে ওড়না হবে নাকি ওমলেট-সেই বিতর্ক রেখে একটা সাদামাটা প্রশ্ন করি পাঠ্যপুস্তক প্রণেতা এবং শিক্ষাবিদদের কাছে। তা হলো, সামগ্রিকভাবে আমাদের শিশুদের আমরা আসলে কী পড়াচ্ছি? আমার মতো যারা মফস্বলের স্কুলে পড়েছেন, তাদের সবার অভিজ্ঞতাই মোটামুটি অভিন্ন। যেমন আমাদের শিক্ষকরা আমাদের বর্ণ পরিচয় শেখাতে গিয়ে মূর্ধণ্য ষ-কে বলতেন পেটকাটা মূর্ধণ্য ষ। ধ-কে শিখিয়েছেন কান্ধে বাড়ি ধ। র-কে শিখিয়েছেন ব-এ শূন্য র আর ড়-কে শিখিয়েছেন ড-এ শূন্য ড়। ছোটবেলা থেকেই যদি আমাদের র ও ড়-এর উচ্চারণ অনুযায়ী শেখানো হত, তাহলে বড় হয়ে উচ্চারণের আলাদা ক্লাস করে এগুলো শিখতে হত না।
তিনটি শয়ের (শ, ষ, স) উচ্চারণে যে কোনো পার্থক্য নেই, এই কথা যদি আমাদের শৈশবেই শেখানো হত, তাহলে শয়ের উচ্চারণ নিয়ে বড় হবার পরও আমাদের বিভ্রান্তি থাকত না। বাস্তবতা হলো, এখনও আমরা যাদের বলি শিক্ষক বা জাতি গঠনের কারিগর-তাদের কত শতাংশ আসলে এই কাজের যোগ্য, সেই প্রশ্ন আমি সচেতনভাবেই রাখছি। আমাকে যারা পড়িয়েছেন, তাদের প্রত্যেকের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা রেখেই এ প্রশ্নটি রাখলাম।
ছোটবেলায় আমরা অংক করতে গিয়ে শিখেছি দুধের সাথে পানি মেশানো যায়, আমরা শিখেছি কীভাবে সুদ খেতে হয়, বানরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উপরে ওঠানামার মতো হাস্যকর বিষয়ও আমাদের শেখানো হয়েছে। অথচ অংক শেখানোর জন্য এর চেয়ে অনেক ভালো বিষয় রয়েছে।
যেমন আমরা শিখেছি অ-তে অজগর ওই আসছে তেড়ে। অথচ খুব কম মানুষের ভাগ্যেই সারা জীবনে অন্তত একবার অজগর দেখার সৌভাগ্য হয়। জঙ্গলে তো দূরে থাক, আমাদের দেশের খুব অল্প সংখ্যক মানুষই চিড়িয়াখানায় গিয়ে অজগর দেখেছেন। অথচ অ-তে অজগর ছাড়া আরও অনেক ভালো ও সুন্দর শব্দ রয়েছ, যেগুলো ব্যবহার করলে শিশু বয়সেই কাউকে অজগরের মতো একটা ভয়ঙ্কর প্রাণির নাম শেখাতে হয় না।
একটা উদাহরণ দিই, একজন প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক তার একটি বইয়ে ধানসিঁড়ি নদীর পরিচয়ে লিখেছেন, নদীটি বরিশাল শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। তথ্যটি সম্পূর্ণ ভুল। কারণ ধানসিঁড়ি নদীর অবস্থান বরিশাল শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে ঝালকাঠি জেলায়। কোনো শিশু যখন বইয়ে এই তথ্য পড়বে এবং বড় হয়ে যখন সে জানবে যে  ধানসিঁড়ি নদী আসলে বরিশাল শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যায়নি-তখন ওই লেখক সম্পর্কে তার কী ধারণা হবে? এরকম অজস্র ভুল আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের সন্তানদের শেখাচ্ছি। সুতরাং আলাদা করে ওড়না শব্দটি নিয়ে এখন যে বিতর্ক শুরু হয়েছে, সেই ধারাবাহিকতায় এখন সামগ্রিক শিশুশিক্ষা ও শিশুপাঠ্য নিয়েই আমাদের প্রশ্ন তোলা উচিত।
 
আমীন আল রশীদ : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর
Share: