রবিবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

সাংঘাতিক আর লোভী কসাইয়ের গল্প

সাংঘাতিক আর লোভী কসাইয়ের গল্প

দুটি পেশার মানুষের জন্য আমার মায়া হয়, রীতিমত করুণা হয়। এরা খুব অসহায়। এরা মার খায়, গালি খায়, মরে যায়। মানুষের উপকার করে। তবু তারা মানুষের ভালোবাসা পায় না। মার খাওয়ার পরও মানুষ বলে, ঠিক হয়েছে। গালি খাওয়ার পরও মানুষ বলে, এটা তাদের পাওনা। এ দুই অসহায় পেশাজীবীরা হলো- সাংবাদিক আর ডাক্তার। এইটুকু পড়ে নিশ্চয়ই আপনারা ক্ষেপে যাচ্ছেন, নিশ্চয়ই মনে মনে বলছেন, এরা তো সাংঘাতিক আর কসাই। এদের গালি দেয়া, মারা কোনো ব্যাপারই না।
আপনারা নিশ্চয়ই বলবেন, আপনিও একজন সাংঘাতিক। আপনি তো সাংবাদিকদের পক্ষে লিখবেনই। আসলে আমি নিজে একজন পেশাদার সাংবাদিক না হলে মন খুলে লেখাটা লিখতে পারতাম। কিন্তু এখন কিছু লিখলেই, আপনারা বলবেন, সাংবাদিকদের কিছু হলেই তো আপনারা ঝাঁপিয়ে পড়েন। আর সাধারন মানুষ যে মরছে, তখন তো আপনারা চুপ করে বসে থাকেন। এ অভিযোগ সত্যি নয়। আমি আমার একজন সহকর্মীর পাশে থাকবো, এটা তো স্বাভাবিক। তবে আমি নিছক একজন ব্যক্তির পক্ষে লিখি না, আমি সত্যের পক্ষে লেখার চেষ্টা করি।
গত সপ্তাহে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রতিবাদে তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ডাকা আধাবেলা হরতালের সময় পুলিশ বিনা উস্কানিতে পিকেটারদের ওপর চড়াও হয়। আর পুলিশি অ্যাকশনের ছবি তুলতে গিয়ে ব্যাপক নির্যাতনের স্বীকার হন এটিএন নিউজের দুই সাংবাদিক। আমি যখন পুলিশি নির্যাতনের শিকা্র মিজানুর রহমানকে নিয়ে লিখেছি। সবাই বাহবা দিয়েছেন। সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছেন। কিন্তু যখন আমাদের দুই সহকর্মীকে নিয়ে লিখলাম, তখনই অনেকে রীতিমত ঝাঁপিয়ে পড়লেন। অনেকে বললেন, এতদিন আপনারা সরকারের দমন-পীড়ন-গুম-খুনের বিরুদ্ধে লেখেননি বলেই আজ আপনারা হামলার শিকার হয়েছেন। অনেকে বলছেন, সাংবাদিকরা তো সাংবাদিক নয়, সাংঘাতিক; তারা মানুষকে হয়রানি করে, হেনস্থা করে; তারা মার খেয়েছে ভালো হয়েছে। এটিএন নিউজের দুই সাংবাদিকের বিচারের দাবিতে আমরা যখন রাজপথে মানববন্ধন করতে গেলাম, তখন আবার সেই পুরোনো প্রশ্ন, আপনারা তো এর আগে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদ করেননি, এখন কেন মাঠে নেমেছেন? প্রথম কথা হলো, সাংবাদিকরা অ্যাক্টিভিস্ট নয়। মাঠে নেমে প্রতিবাদ করা সাংবাদিকদের কাজ নয়, তারা জনগণকে তথ্য দেবে। তবে মাঠে নেমে প্রতিবাদ না করলেও লেখায়, বলায় সাংবাদিকরা সবসময় অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন। সাংবাদিকদের সবসময় মাঠে থাকতে হয়। এটা তাদের পেশার অংশ। তাই মাঠে নিরাপদে দায়িত্ব পালনের নিশ্চিত করাটা আমাদের যৌক্তিক দাবি। আমরা শুধু সেটুকুই চেয়েছি। কিন্তু সেই দাবি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই আবার সাংবাদিকের রক্তে রঞ্জিত হলো রাজপথ। গত বৃহস্পতিবার সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের মনিরামপুরে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় দায়িত্ব পালনকালে গুলিবিদ্ধ হন দৈনিক সমকালের সাংবাদিক আব্দুল হাকিম শিমুল। শুক্রবার দুপুর পৌনে ২টার দিকে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বগুড়া থেকে ঢাকা আনার পথে মারা যান তিনি। ফেসবুকে শিমুলের মৃত্যুর হন্য দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়েছি। চেয়েছি সাংবাদিকদের নিরাপদ কাজের পরিবেশ। কিন্তু সেখানেও কেউ কেউ মন্তব্য করেন, দুই পক্ষের সংঘর্ষে সাংবাদিক কোন পক্ষে ছিলেন? তিনি সেখানে গিয়েছিলেন কেন? কোথাও সংঘর্ষ শুরু হলে সাধারন মানুষ যখন দৌড়ে পালান, সাংবাদিকরা তখন সেখানে ছুটে যান। আর সাংবাদিকরা পক্ষে থাকেন না। তারা তথ্য সংগ্রহ করতে যান। আব্দুল হাকিম শিমুলের রক্তাক্ত দেহের ছবি যৌক্তিক কারণেই আমরা দেখাইনি। তবে তার রক্তাক্ত পরিচয়পত্রটি অনেকে শেয়ার করেছেন। রক্তাক্ত ‘press’ আমাদের শঙ্কিত করে, আতঙ্কিত করে।
ঢাকার সাংবাদিকরা মার খেলে আমরা যতটা প্রতিবাদ করি, ঢাকার বাইরের সাংবাদিকরা মরে গেলেও ততটা করি না। এটাই ঢাকার বাইরের সাংবাদিকদের ট্র্যাজেডি। তারা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, জীবনের ঝুকি নিয়ে সাংবাদিকতা করেন; কিন্তু আমরা তাদের জীবনটাও বাঁচাতে পারি না। কয়েকদিন আগে প্রথম আলোর প্রধান আলোকচিত্রী জিয়া ইসলাম সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন। এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে বাইরে পাঠিয়ে তার জীবন বাঁচানো গেছে। কিন্তু আহত শিমুলকে সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকা আনতে একটা হেলিকপ্টারের ব্যবস্থাও আমরা করতে পারিনি। অনেকেই ‘মফস্বল সাংবাদিক’ বলে আলাদা বিভক্তি সৃষ্টি করেন। কিন্তু আমি কখনোই এভাবে দেখি না। সবাই সাংবাদিক। কারো পোস্টিং ঢাকায়, কারো সিরাজগঞ্জে। ঢাকার বাইরে বলে অবহলো করার সুযোগ নেই। মোনাজাতউদ্দিন তো ঢাকার বাইরে থেকেই সাংবাদিকদের প্রাতস্মরণীয় হয়েছেন।
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আপনাদের অনেক ক্ষোভ তা জানি। আপনাদের অভিযোগে কিছু সত্যতা আছে, তাও মানি। তাও সাংবাদিকরাই কিন্তু এখনও জোর গলায় প্রতিবাদ করেন। বর্তমানে সংসদের বিরোধী দল গৃহপালিত, আর রাজপথের বিরোধী দল অথর্ব। তখন সরকারের অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি, দমন, পীড়ন তুলে ধরার একমাত্র উপায় গণমাধ্যম। ভুক্তভোগী মানুষ পুলিশের কাছে যায় না। তাদের ধারণা পুলিশের কাছে গেলে তাদের আরো হয়রানি হতে হবে। প্রতিকার পেতে তারা আসে সাংবাদিকদের কাছে। প্রতিদিন আমাদের অফিসে নানান ধরনের লোকজন আসে বিচিত্র সব সমস্যা নিয়ে। তাদের ধারণা পত্রিকায় বা টিভিতে একটি রিপোর্ট হলেই তার সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। অনেকে আসে বিভিন্ন ডিসি, এসপি বা ওসির ফোন নাম্বার নিয়ে। একটা ফোন করে দিলেই নাকি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। একজন অপরিচিত মানুষকে যে চাইলেই ফোন করা যায় না, এটা তাদের বোঝানো যায় না। প্রতিদিন যারা আসেন, তাদের সবার কথা আমরা শোনার চেষ্টা করি। সম্ভব হলে সাহায্য করারও চেষ্টা করি। কিন্তু তারপরও অনিবার্যভাবে ‘সাংঘাতিক’ গালি শুনতে হয়। এটাকে আমরা পেশার বিড়ম্বনা হিসেবেই মেনে নিয়েছি, এটা আমাদের বোনাস প্রাপ্তি। অনেক খারাপ সাংবাদিক যেমন আছে, তেমনি অনেক বেশি ভালো সাংবাদিকও আছে। আমি দাবি করে বলতে পারি, দেশে ভালো সাংবাদিকের সংখ্যাই বেশি।
সাংবাদিকের মতই আরেক অসহায় পেশাজীবী ডাক্তার। আমরা অসুস্থ হলেই ডাক্তারের কাছে ছুটে যাই। আর সুযোগ পেলেই কসাই বলে গালি দেই। রোগীদের সময় কম দেয়া, ভুল চিকিৎসা, অপ্রয়োজনে টেস্ট করতে দেয়া, বাড়তি টাকা নেয়া- ডাক্তারদের বিরুদ্ধে এমন অনেক অভিযাগ আছে। কিন্তু সব ডাক্তার তো আর কসাই নয়, খারাপ নয়। তাহলে তো এতদিনে আমরা মরে ভুত হয়ে যেতাম। এতদিন তো আম জনতা ডাক্তারদের গালি দিতো। এখন রীতিমত সরকারিভাবে ডাক্তারদের ‘লোভী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এবার এসএসসির বাংলা পরীক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্ন এসেছে, ‘জাহেদ সাহেব একজন লোভী ডাক্তার। অভাব ও দারিদ্র বিমোচন করতে গিয়ে তিনি সবসময় অর্থের পেছনে ছুটতেন। এক সময় গাড়ি-বাড়ি, ধন-সম্পদ, সব কিছুর মালিক হন। তবুও তার চাওয়া পাওয়ার শেষ নেই। অর্থ উপার্জনই তার একমাত্র নেশা।‘ কী অসাধারণ সৃজনশীলতা! দেশে জাহেদ সাহেবের মত ডাক্তার নিশ্চয়ই অনেক আছে। কিন্তু একটি পাবলিক পরীক্ষায় একটি পেশার মানুষদের ঢালাওভাবে লোভী হিসেবে চিহ্নিত করা রীতিমত অপরাধ।
দেশে শুধু যে সাংঘাতিক সাংবাদিক আর লোভী কসাই ডাক্তার আছে তাই নয়; সব পেশাতেই ভালো মন্দ আছে। খারাপ পুলিশ, খারাপ আইনজীবীও আছে। তাই নির্দিষ্ট কোনো পেশাকে গালি দেয়ার জন্য টার্গেট করা ঠিক নয়। তবে আপনারা যদি গালি দিয়ে আরাম পান, তাহলে আমার কোনো আপত্তি নেই। 
ডাক্তারদের অপমান করলে ডাক্তাররা প্রতিবাদ করেন, সাংবাদিকদের মারলে সাংবাদিকরা প্রতিবাদ করেন; আমি এই প্রবণতার বিরুদ্ধে। অন্যায় সবসময় অন্যায়। এর প্রতিবাদ করতে হবে সবাইকে। সাংবাদিকরা মার খাচ্ছে, আপনি আড়ালে মুখ টিপে হাসবেন; ডাক্তার গালি খাচ্ছে, আপনি আড়ালে মজা নেবেন; তাহলে একদিন আপনিও অন্যায়ের শিকার হতে পারেন। তখন কিন্তু আপনার পাশে কাউকে পাবেন না। তাই সব অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে সবাইকে, যার যার জায়গা থেকে। বিবেকের ডাকে সাড়া দিতে হবে সবাইকে।
প্রভাষ আমিন : সাংবাদিক, কলাম লেখক।
probhash2000@gmail.com
Share: