বৃহস্পতিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

জীবনকে উল্টে দেখার কবিতা

জীবনকে উল্টে দেখার কবিতা


চেনাজানা বস্তু, সম্পর্ক, পরিবেশ, পরিস্থিতি যেকোনো কিছুকে এক লহমায় পাল্টে দেওয়া সম্ভব বোধকরি কবিতার মাধ্যমেই। অন্য কোনো আর্ট ফর্মের এত তীক্ষ্ণতা নেই। শব্দকে ধারাল করে তুলতে কবির মতো আর কেউ পারেনও না বোধকরি। যেমন শারমিন রহমান। কেমন অবলীলায় তিনি উল্টেপাল্টে দিতে পারেন দৃশ্যপট, চেনা জমি, কাছের মানুষ, বিশ্বাস, সামাজিকতা। তিনি শুধু ভাঙেনই না, তার গন্তব্যও আছে। এক রোম্যান্টিক জীবন ও জগতের দিকে তার যাওয়া আছে। কামনা ও বাসনা আছে। তিনি আছড়ে ফেলেন পাঠককে নির্মমতায়, যেমন আলগোছে তুলে নিয়ে যান মমতার ওমে। তার ‘লাল স্কার্ফ আর একটা করে ষাঁড়’ ২০১৭ সালের বই মেলায় প্রকাশিত হয়েছে। বইয়ের নাম, বাইরের প্রচ্ছদ আর ভেতরের কবিতায় এমন একটা সামঞ্জস্য আছে। লড়াই করে জিতে নেওয়ার, লড়াইকে পাশ না কাটিয়ে তাকে মোকাবিলার আবশ্যিকতা নিয়েই যে আমাদের জীবন তা শারমিন রহমানের মতো করে আর কোনো কবিকে কী বলতে শোনা যাচ্ছে ইদানিং কালে? তার বইটি বাজারে এনেছে চৈতন্য প্রকাশনি।
 
শারমিন রহমান ইমেজ নিয়ে খেলা করেন। তার কবিতায় অজস্র ইমেজ পাওয়া যাবে। ইমেজের রূপান্তর ঘটে যায় তার কবিতায়। তারা নিজেদের অপ্রত্যাশিত অর্থ প্রকাশ করে। কত কিছুকে লুকিয়ে থাকে আমাদের পরিচিত ইমেজগুলোর মধ্যে তা শুধু কবির চোখেই ধরা পড়ে। পাণ্ডুলিপিতে তার প্রথম কবিতাটির নাম ‘সুইসাইড নোট’। দুই লাইনের কবিতাটি এমন- ‘দীর্ঘশ্বাসে উড়ে যেতে পারে/এই ভয়ে সুইসাইড নোট লিখি নাই।’ সমাজজীবনে অত্মহত্যার চাইতে এর কারণ উদ্ধারে বেশি চাঞ্চল্য দেখা দেয়। মানুষের দীঘল জীবন ছোট্ট একটি সুইসাইড নোটে এসে পরিসমাপ্তি ঘটে। এ কবিতাকে শুধু আত্মহত্যার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ করে রাখবে না পাঠক। কারণ প্রতিনিয়ত ব্যক্তি কোনো না কোনো কিছুর একটা ‘ডেড এন্ড-এ’ পৌঁছায়। পরাজিত হয়। পরাজয়ের কারণে পৌঁছেই সে স্বস্তি পেতে পছন্দ করে। শারমিন ঠিক করেছেন কাউকে স্বস্তি দেবেন না। ফলে তার দীর্ঘশ্বাস অনেক বড়। জীবনের গভীর থেকে উঠে আসা বেদনার সমান সেই শ্বাস। পরের কবিতার নাম ‘এপিটাফ সংক্রান্ত’। এটিও সেই জীবনের কথা বলছে- ‘একটা পাথরকে জানি এপিটাফের সাথে পাঞ্জা লড়ছে।’
জীবনকে দেখার, বোঝার এর কলকব্জায় মরচে পড়ে যাওয়া শারমিন দেখতে পেয়েছেন। সেগুলো নিয়ে বেশ কয়েকটি কবিতা তার আছে। ‘পরিবার বিষয়ক’ কবিতায় আছে- ‘যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতায় পড়ে থাকতে থাকতে/আর নাড়ী মুচড়ে প্রচণ্ড ব্যাথায় ককিয়ে উঠতে গিয়ে আবিষ্কার করি/পাশের বালিশ জুড়ে শুয়ে আছে ব্যাথার মত সুখ,’। অর্থাৎ, ব্যাথা ও সুখ এই দুই সংসারের পরম অনুষঙ্গ। কিন্তু প্রধানটা কী, সম্পর্ক। সেই সম্পর্ক আসলে কার সঙ্গে কার, ‘বিবাহ’ যে আমরা বলি তা কার সঙ্গে কার? এ নিয়ে প্রশ্ন করার হিম্মতও আছে তার কবিতায়।
শারমিনের এই বইয়ের অনেকগুলো কবিতা বাঙালি সংসারের মধ্য ঘোরাফেরা করে। কিন্তু তাদের অভিষ্ট দার্শনিক। সেখানে শিল্প অথবা সংসারকে প্রশ্ন করা হয়। জানতে চাওয়া হয় তার কাছে যা আমরা করছি, যা হচ্ছে তার আসল মানেটা কী? তার এসব কবিতার ইমেজগুলো সাংঘাতিক ব্যঞ্জনা তৈরি করে। অনেক ফাঁকা এটা স্থানে পাঠককে ছুঁড়ে দেয়। হতবিহ্বল করে দেয়। ‘নখ’ কবিতায় আছে- ‘আর যত খানেক দিন/বস্তির মেয়েদের মাথার উকুনের/মত/কিলবিল করত আবেগ,/আমি মনে মনে/মনের আঙুলে/টুশটুশে নখ গজাতাম,/মাথার আগায় বেঁধে রাখতাম/সন্যাসির মতন জটা,/চুল আঁচড়াতাম না/যথাসম্ভব।/আমার সত্যিকারের নখে উকুন কামড়ালে/ব্যাথা পাই।’ আবেগ শিল্প সৃষ্টির তাড়না তৈরি করে ঠিকই কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে সে যায় না। সে সত্যিকারের নখকেও কামড়ে ধরে উকুন হয়ে, ছাড়তে চায় না।
কিম্বা আমরা যে শিল্প করছি তা কোন চোখে? শারমিন বলছেন তা একটা চশমা পরা চোখে। ‘জানলা থেকে চশমাটাকে অনেকভাবে মুছতে চাই,/পারি না।/চশমাটা ভোটের দিনে বৃদ্ধাঙ্গুলির অসহ্যের মত।’ (চশমার ভিতরে শহর।) সবকিছুই তার আসলটাকে হারিয়েছে। চোখ মেললেও আমরা নির্ধারণ করে দেয়া দৃশ্যপট দেখতে পাব। আমাদের কল্পনার ঘর বন্ধ হয়ে গেছে। কবির তাই আর্তি- ‘আমি প্রিয় শহরটার কিছু কিছু ছবি আঁকতে চাই,/কল্পনায়।/পারি না।’ (চশমার ভিতরে শহর)
সহজ বিষয়গুলোই আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের শিল্প মহিমাও কমে গেছে। ‘কেননানা/বর্ণ আর ধ্বনির বাইরে/স্পর্শ করি জৈবিক।’ (কবিতাকে ছুটি দিয়ে দিতেই হয়)। বর্ণ ও ধ্বনির যে কারবার তার মধ্যে আমাদের থাকা হচ্ছে না আর। আমরা বড় বেশি জৈবিক চাহিদার দিকে ছুটছি, সেদিকে নিবিষ্ট ফলে শিল্প মহিমা খর্ব হচ্ছে। আমরা টাকা হয়ে যাচ্ছি নিজেরা স্বেচ্ছায় কিম্বা পরিস্থিতির ফেরে পড়ে। বিনির্মিত হচ্ছি। মঞ্চে যা করব বলে উঠছি, ওঠার পর দেখি সেখানে ভিন্ন বাস্তবতা। শেষ পর্যন্ত ‘টাকার মেশিনে আমি/ছাপা হতে থাকি।’ (বিনির্মাণ)
শারমনি রহমান তার বইয়ে অনেক ধরনের কবিতার সমাবেশ ঘটিয়েছেন। প্রাচীন বাংলা পদ বা বচনজাতীয় কবিতা রচনার চল ছিল। ছোট্ট দুই-তিন লাইনে বিষয়গুলো তুলে ধরা হতো। যেমন সুইসাইড নোট কবিতাটির কথা ধরা যাক। অথবা এমন কবিতা তার আরো আছে গুচচ্ছ কবিতা এবং অন্যান্য নামে। কাছাকাছি ধরনের মধ্যে জাপানের হাইকু কবিতার প্রভাবও আমাদের ভাষায় রয়েছে। তার কবিতায় পপ সংস্কৃতির উপস্থিতিটা আছে। বিভিন্ন ইমেজের ব্যবহার, তাদের অর্থকে নিজের মতো করে নির্মাণ করা, প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া, অনেক কিছুকেই না মানা,ভেতরে গভীর ক্রোধ জমা করে রাখা-মোটামুটি পপ কালচারের কবিতাও এই বইয়ে রয়েছে। যেমন- ‘লণ্ঠন’। কবিতাটি এমন, ‘এত কিছু দ্যাখে/এত সূক্ষ/আমার দাদার আমলের খাঁজ কাটুনি মনে হয় তারে।/এত সুন্দর ফুল/ছুঁতে গেলে আবার দিয়ে দিবে/একটা/উপমা। এই নিদারুন ব্যস্ততায় একে কি ডাকি?/ড্রাম্যাটিক রিলিফ?’
পপ কবিতা ইল্যুসন তৈরি করে। একের ভেতর সে অন্যকে দেখতে পায়। যদিও এর সঙ্গে শারমিন রহমান নিজস্বতাকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি ফিউশন করেছেন। সর্বসাম্প্রতিক কবিতার ধরনের সঙ্গে তিনি তার অভিজ্ঞতা, রুচি ও দর্শনকে গেঁথেছেন। ফলে সেগুলো অন্যের অনুকরণ হয়নি। বরং এই কবি তার উপমা আর কল্পনা দিয়ে আমাদের চোখ খুলে দেন একের পর এক। মায়াবি এক অনুভূতি জাগে কখনো।
কখনো আমাদের বিভ্রম জাগবে তার কবিতা পড়লে। ‘লিখতে লিখতে চোখ চলে যায় ডান দিকে। হলুদ ব্লাউজ। টশটশে বুক ফেটে বেরিয়ে যেতে চাচ্ছে। পাখির খাঁচার মত, অসম্ভব বন্দী তাকে মনে হয়। আমি ঘর খুঁজে খুঁজে খাঁচা পাই বারবার। বারবার এই খাঁচায় আমি ঘর বানিয়েছি।’(জিগলো)। এখানে খাঁচা নিজেই বন্দী। খাঁচার ভেতর যে বন্দী থাকে তার চেয়ে ভীষণ বন্দি খাঁচা নিজেই। কারণ সেও বন্দী। আর খাঁচা দিয়ে ঘর বানিয়ে সেখানে ব্যক্তির বসবাস। কী দারুণ কাব্যিক দৃশ্য আমাদের চোখের সামনে তিনি ফুটিয়ে তুলতে পারেন।
রয়েছে বিদ্রোহ আর অকপট স্বীকারোক্তিও। ‘কেমন আছে খোদার কসম/কেমন আছে বিদ্যা, মা কালী?/কেমন আছে মাথা ছুঁয়ে বলা/কেমন আছে তিন সত্যি, কেমন আছে?’ (কি তুমি সময় সম্পর্কে?)। এসব সামাজিক বিশ্বাস এখন ফিকে হয়ে গেছে। সহজ, স্বাভাবিক সম্পর্ক ছেড়ে আমরা এখন জগদ্দল বয়ে জীবন কাটাতে ভালোবাসি।
শারমিনের কবিতার অনন্য আরেক দিক হলো দায়বদ্ধতা। তিনি অন্য কবিদের প্রতি দায়বদ্ধ, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ, তার ইতিহাসের ও পরিপার্শ্বকে অস্বীকার করেন না । তিনি লেখেন, ‘দুঃসময়ে টুপ করে আম্মার পেটের ভিতর ঢুকে বসে থাকি।/ওখানে আরও আরও হাত পা পেট নাক মুখ গাল মাথা শরীর পেয়ে যাই।’ (আম্মার নেভোযান)।  অথবা আরো আরো কবিদের প্রতিও তিনি নিজেকে যুক্ত দেখতে পান। যেমন শ্রাদ্ধ কবিতায় আছে- ‘শস্যকালে টি-পয়ে চা, কফি এসব তো মজুদ আছে, শুধু তোমাদের প্রিয় কবিদের নাম জানি না বলে আমি শোক করতে পারি না।’
আমরা যে দেখি আমাদের প্রতিবেশ সেখানে থাকে অনেক কিছু। আমরা আবর্জনা জমাই। আমাদের চোখের সামনে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে কোনো স্থাপনা। এসবকিছু আসলে মানুষের স্মৃতিকে সংরক্ষণ করে। এদের প্রত্যেকর ভেতরে থাকে আলাদা আলাদা অর্থ। এরা প্রত্যেকে যুক্ত আমাদের সঙ্গে। এরা ইতিহাসেরই উপজাত, কেউ বন্ধ্যা নয়। প্রত্যেকের গর্ভে রয়েছে অনাগাত। তার ভেতর ঢুঁ মারেন কবি শারমনি রহমান। যেমন তার এই কবিতাটির পড়া যাক, ‘টের পাচ্ছো?/চিমনির পাশে/উর্বরা শুয়ে আছে ছাই/সেখানে প্রাক্তন ধোঁয়ার কুণ্ডুলি।’(গুচ্ছ কবিতা ১)
শারমিন তার কবিতায় জড়ো করেছেন পশ্চিম ও প্রাচ্যের নানা মেটাফোর। কবিতার বিভিন্ন ধরনের কথা তো আগেই বলেছি। দার্শনিকভাবেও তিনি সংসার ও জগতজীবনের আগাপাশতলা ঢুঁড়ে বেরিয়েছেন। তিনি যেন সেই ষাঁড় যার সামনে লাল স্কার্ফ হয়ে জীবন ও দর্শন ঝুলে আছে। আর তিনি প্রাণবন্ত এক ক্ষ্যাপাটে কবি হয়ে এঁফোড়ওফোঁড় করে দিচ্ছেন বাস্তবতা। আর তাতে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে আমাদের সময়ের কী হাল তা। নিজের বহুমাত্রিকতা দিয়ে সময়ের যে প্রতিচ্ছবি তিনি নির্মাণ করেছেন তা বিচিত্র ও সলিড। এই কবি আত্মবিশ্বাসী। তার মনেবলে চীড় ধরে না। ভাষায়ও তিনি বেশ প্রঞ্জল। প্রমিতের মেকিনেসে নিজেকে আটকে রাখেননি। এই বইটি কবিতা বোদ্ধা অথবা পাঠকরা পড়বেন আশা করছি। তাদের অনেক মঙ্গল এতে নিহিত আছে নিশ্চয়।  
Share: