হার না মানা কয়লাকালো শরীরের কাঁধ ঘুরিয়ে, ধবধবে সাদা কাফনের রঙের শাড়িটি প্যাঁচানো। পথিকের কৌতূহলী আড়চোখের দৃষ্টি এড়ায় না। কেননা মাথার প্রায় চুল সাদা হলেও ব্লাউজ ছাড়া অংশটুকুতে বোঝা যায় শরীরের বাঁধন আজো অনড় জীবনের তাগিদ ও কর্মে। এখানে বয়স কেবল ঠেস্ দিয়ে আছে।
সন্ধ্যা নাগাদ কৃষ্ণচূড়া গাছের ফাঁকে,একটু পুবে জেল গেইটের আশপাশে বাতি জ্বলে উঠে। আর রাস্তার উত্তরে বিখ্যাত মাজারের ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে রঙ বেরঙের বাতির চিকিমিকি বাহার! অথচ মাঠের পশ্চিমে পথচারী চলাচলপথে জীর্ণ কাঁথা বিছিয়ে, সাত-আট মাসের বুকের বাচ্চাটিকে শুয়ে রেখেছে আলেয়া। জায়গাটিতে আলো নেই,আবার অন্ধকারও না। একটা মশার কয়েলের ধোঁয়া ও ক্ষীণ আলোয় বাচ্চাটি আকাশে হাত-পা ছুঁড়ছে বালিশহীন। গায়ে একটা সুতোও নেই। এদের জন্য তবে গরমকাল আশির্বাদ!
বাচ্চাটিকে পিছ দিয়ে মনের সুখে বিড়ি ফুঁকছে আলেয়া,ভাবলেশহীন। ভাঙা দেয়ালের উপর থেকে এক মধ্যবয়স্ক পুরুষের চেয়ে থাকা শাড়ির ভেতর ঢুকতে চায়,হয়তো মুখে কুত্তার মতো লালা গিলছে। আলেয়া হঠাৎ হঠাৎ ঘাড় বাঁকিয়ে ডান হাতে বাচ্চার মুখ টেনে টেনে আদর করে, ও সোনা, ও যাদু...আমার রা - জা,আমার মা- নিক...
বাচ্চাটি মুখের কাছে মায়ের হাত পেয়ে দু'হাতে জাপটে টেনে একগাল হাসিতে, মুখে পুরে আঙ্গুল চুষতে থাকে। আলেয়া মুচকি হেসে বলে উঠে, ও মা - আমার কলিজার ক্ষিধা লাগলো বুঝি। আহা।
আদর করতে করতে বুকে নিয়ে দুধ তুলে দেয়। দেয়ালের উপর থেকে পুরুষটি চিলিবিলি করে বাচ্চার দুধপান দেখতে চাচ্ছে। আর বাচ্চাটি হয়তো পর্যাপ্ত দুধ না পেয়ে পেট মোচড়িয়ে মোচড়িয়ে কঁকিয়ে কেঁদে উঠছে।
আলেয়া চৈত্রের কাঠফাটা রোদে পুড়ে,ঘামে ভিজে সারাদিনের কাটুনিতে, এসব মালুম না হলেও কেবল গা- মরা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। প্রতিদিন দুইবেলা রাস্তার মোড়ে গ্যাস পাম্পের থমে, দুটি আন্ডি ডেক্সি দিয়ে ভাত বেচে। এক প্লেট মাত্র ত্রিশ টাকা । আন্ডি ডেক্সি একটাতে ভাত ও অন্যটাতে পাঁচমিশালী তরিতরকারি। বাসন নিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ হাটু মুড়ে খাবার খেয়ে যায়। এখানে সবাই যেন তাড়া খাওয়া মাছি। এ খোলা জায়গায় পথচারীর সম্মুখে খাবার খেতে এতোটুকু মাথায় চিড় ধরছে না। এখানের সবাই সুখি এ খাবারে...
সন্ধ্যা ঘনায়ে এলে চারদিকের নানারঙের বাতিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে আলেয়া। তাকিয়ে থাকাতে আরামবোধ হয়। তার বুকে দুধ নেয়,অথচ দুধের পিটার কাছের দোকানে কাঁচের গ্লাসে গ্লাসে। বাচ্চার বিভিন্ন দুধের কৌটা,খেলনার দিকে তাকিয়ে থাকাতে আনন্দ! কোনো পথচারী পুরুষের হাতে দেখলে হিংসে হয়। অথচ নারীর হাতে দেখলে আলেয়ার ভেতর আনন্দ আসে কর্ণফুলির নদীর দু'কূল ছাপিয়ে। কখনো কখনো বুক চাপিয়ে কান্না।
মশার কয়েল জ্বলা প্রায় শেষের দিকে,তেমন রাতও। আলেয়ার বুকে উঠে আসে এক মনুষ্য প্রাণী,রেঁদা পোকার মতো। শুরু হলো খাবলা খাবলি। আধামরার মতো আলেয়া চুপচাপ। সে বুঝে গেছে কে আসতে পারে। তবে চপচপে ভেজা মোটা কাপড়ের, দরমের মতো শরীরে চাপে আলেয়ার দম বন্ধ হয়ে আসছে। সে চেঁচিয়ে মনুষ্যটারে বুক থেকে ফেলে দেয়।
মনুষ্যটি দ্বিগুণ চেঁচিয়ে বলে - খানকী মাগী এতো দেমাগ দেহস্ ক্যান...?
আলেয়া ক্যাৎ হয়ে পড়া মনুষ্যটার কলার টেনে মুখের কাছে এনে বলে- শালা,খেতে এলি যখন ইউনিফর্ম খুলে আসতে পারলি না...?
' ইউনিফর্ম তোরে কী করে...?
' পুরো বাংলাদেশ চুদতে আসে মাগীরপুত...
' তাড়াতাড়ি দে খানকি
' আগে ইউনিফর্ম খোল্
মনুষ্যটি আর না পেরে ইউনিফর্ম খুলে তার মকসুদ পূরণ করে। আলেয়ার বুকে হিসহিসানি,ধড়পড়াতে ধড়পড়াতে শান্ত হয়। এলিয়ে পড়ে। ইউনিফর্ম গায়ে দিয়ে চলে যেতে পা বাড়াতে আলেয়া তড়িৎগতিতে তার পা জাপটিয়ে ধরে।
' ঐ শালা,টেয়া দিবি না...?
' কাল নিস্
' সেটার বেইল নাই, সূর্য উঠলে তোরে আমি চিনি না। টেয়া দে আমার
মনুষ্যটি প্যান্টে হাত ঢুকানোর আগে ও পরেও জানে,তার একটা এক হাজারি নোট ছাড়া আর একটা পয়সাও নেই। তাই টাকা দিতে এতো গড়িমসি। প্যান্টে হাত ঢুকিয়ে রেখেছে,হাত বের হতে চাচ্ছে না। হঠাৎ মোড় ঘুরিয়ে একটা টহলরত পিকআপ তাদের দিকে আসছে। হেডলাইটের আলো পড়তে সে টাকাটা ছুঁড়ে দিলে,আলেয়া পা ছাড়ে। মনুষ্যটি নিচুস্বরে খানকী মাগী বলে দৌড়ে গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে গাড়িটিকে স্যালুট দেয়।
০২.
কয়েকদিন পরে মাঠটিতে ঐতিহ্যবাহী বলি খেলাকে কেন্দ্র করে পুরো নগরীটা উৎসবে সাজে সাজ। বালুর উপর দুটো উদোম গায়ের ধস্তাধস্তি। ঘামের দেদারসে জলপতন। একজনকে আরেকজন বগলে চাপিয়ে দাঁত খেচে উপস্থিত কৌশলে বালিতে শুয়ায়ে দিতে চায়। এটা যেন রাষ্ট্রে- রাষ্ট্রে,সমাজে - সমাজের রাজনীতির যুতসই স্থিরচিত্র। চারদিকে গোলায়ে বাঁশ বাঁধায় উপচেপড়া দর্শকের চিল্লাচিল্লি। হৈ চৈ। বেয়ারিং পার্টির মানুষগুলো ফোলা ফোলা পেশির সর্বশক্তি দিয়ে ঢোল পিটাচ্ছে আর বাঁশিওয়ালারা গাল ফুলিয়ে অজিরানি বাজিয়ে চলছে। এখানে শিল্প ও শিল্পীর মাস্তানি। আলেয়ার থাকার জায়গায় হাত পাখা,চালন - কুলা বেচাবেচি। ক্রেতারা দু'হাতে হাতপাখা বাতাস করে করে কিনছে। স্তূপাকার রংঅলা চনামনার টেং,তিলের হাজা,গজা,টপি - আমিত্ত্বের পসরা তের্পাল দিয়ে ছাউনি দেওয়া একেকটা দোকান। মাঠের একপাশে দু' তিনটা নাগরদোলা, খেলনাপাতির জিনিসের দোকান। আলেয়া ছেলেকে কোমরে নিয়ে মেলার দক্ষিণ পাশ থেকে পুতুল ও একটা বন্দুক কিনে প্লাস্টিকের। ফ্যাকাশে মুখে এদিকওদিক চাইতে চাইতে হেঁটে কিছু দূরে দক্ষিণ - পশ্চিমে মার্কেটের পিছনের দেয়াল ঘেঁষে বসে। তখন মাগরিবের আজান হচ্ছে পাশের মসজিদ থেকে। মাথায় আঁচলা টেনেটুনে বন্দুক উঁচিয়ে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে সগৌরবে বলতে থাকে - কেউ জানে না,তোর বাপ কি। সবাই ভয় পায়,সবাই সালাম দেয়। তোর বাপ তো ইয়া বড়...
ছেলেকে হাসাতে গিয়ে হঠাৎ বুক চেপে ধরে আলেয়া,পরাণটা নড়েচড়ে বুঝি। মুখ মলিন হয়। জীবনের ঘানি টানতে টানতে অবসাদে পেয়েছে আজ।
তবুও চোখের জল চোখে থেকে গেল আলেয়ার,বেয়ে পড়ে না। হয়তো ছেলেটি বড় হতে হতে আলেয়া আর থাকবেও না এ পৃথিবীতে। বলতে পারবে না তার বাপ আছে,বলতে পারবে না সে অনাকাক্ষিত,অসাবধানে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল...