বোরহান বিশ্বাস: দক্ষিণ দনিয়ার গোয়ালবাড়ি মোড়ের শাহী মসজিদ সড়ক, বায়তুস সালাম জামে মসজিদ সড়ক কিংবা গোয়াল বাড়ি সড়ক- তেমন প্রশস্ত নয়। তবে এ সরু সড়কগুলোর যে কোনো একটি দিয়েই চলে যাওয়া যায় দনিয়া পাঠাগার ও দনিয়া স্টুডিও থিয়েটার হলে।

পাড়া-মহল্লায় পাঠাগার থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু স্টুডিও থিয়েটার হল? সুস্থ বিনোদনের জন্য যে তাও হতে পারে সেটি প্রমাণ করেছেন দনিয়ার কিছু সংস্কৃতিমনা তরুণ। অপেক্ষাকৃত কম উন্নত এলাকাও যে সাংস্কৃতিক চর্চার পীঠস্থান হতে পারে তা তারা করে দেখিয়েছেন।
আশির দশকের একেবারে শেষ ভাগে কয়েকজন তরুণের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে দনিয়া পাঠাগার। গোয়ালবাড়ি মোড়ের সেদিনের সেই টিনের ঘরের পাঠাগার থেকেই গড়ে উঠেছে আধুনিক মানের স্টুডিও থিয়েটার হল। দনিয়া পাঠাগারের অধীনেই পরিচালিত হচ্ছে এটি। এখানে একসঙ্গে ১০০ জন দর্শক প্রদর্শিত নাটক কিংবা চলচ্চিত্র দেখতে পারেন। এই মঞ্চে এরই মধ্যে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সফল আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। আর প্রতিটি অনুষ্ঠানেই দর্শকদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
গত বছর ৯ ফেব্রুয়ারি দনিয়া পাঠাগারের ভবন নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান মোল্লা। চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি এটি উদ্বোধন করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জআমান নূর এমপি। উদ্বোধনী দিন থেকে চার দিনব্যাপি চলে আন্তর্জাতিক একক নাট্যোৎসব (ভারতের তিনটি ও বাংলাদেশের চারটি দল এতে অংশ নেয়)। এরপর ২২ থেকে ২৬ মার্চ চলে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র উৎসব।
এ বছর ২৩ মার্চ দনিয়া সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত শিশুতোষ চলচ্চিত্র উৎসবে স্কুল ছাত্রছাত্রীরা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘গেরিলা’ উপভোগ করে। এছাড়া শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘দীপু নাম্বার টু’ এবং মঞ্চনাটক ‘অতঃপর মাধো’র প্রদর্শনীও উপভোগ করে শিক্ষার্থীরা।
গত ২১ জুন দনিয়া সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে এবং দনিয়া স্টুডিও থিয়েটার হলের সহযোগিতায় ‘আধুনিক বাংলা নাট্যে নিজস্বতার খোঁজ’ শীর্ষক সেমিনারে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক দেশি-বিদেশি সংস্কৃতিকর্মী উপস্থিত হয়েছিলেন। এতে ভাবনা থিয়েটার ম্যাগাজিন, কলকাতার সম্পাদক অভীক ভট্টাচার্যের প্রবন্ধের ওপর আলোচনায় অংশ নেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. আফসার আহমেদ, নাট্যজন অনন্ত হীরা এবং নাট্য সমালোচক আবু সাঈদ তুলু। অনুষ্ঠানে ভারতের বিশিষ্ট নাট্য গবেষক আশীষ গোস্বামীও আলোচনায় অংশ নেন। অনুষ্ঠানটির সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনা করেন সংস্কৃতিজন গোলাম কুদ্দুছ।
দনিয়া পাঠাগারের সাবেক সভাপতি, দনিয়া স্টুডিও থিয়েটার হলের পরিচালক এবং ঢাকার মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়ের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহনেওয়াজ।
গোয়ালবাড়ির এমন সরু পথ দিয়ে দেশ ও দেশের বাইরের নাট্যজনেরা যখন সেমিনারে আসছিলেন তাদের অভিব্যক্তি কেমন ছিল?
জানতে চাইলে শাহনেওয়াজ বললেন, রাস্তার ছোট্ট পরিসর দেখে প্রথম দিকে তারা কিছুটা সঙ্কোচবোধ করলেও পরে সবাই আমাদের নাট্যমঞ্চ নির্মাণের উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
সেমিনারের এক পর্যায়ে তারা বলেন, বড় বড় হল না করে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে এমন ছোট ছোট স্টুডিও থিয়েটার হল করলে মানুষ উৎসাহিত হতো।
সারা বছর দর্শকের চাহিদা মেটানো হবে কী করে? কিংবা এ মঞ্চের দর্শকইবা কারা হবেন?
শাহনেওয়াজ বলেন, “আমাদের ২৫ জন মঞ্চবন্ধু সদস্য আছেন। যারা এক হাজার টাকা দিয়ে এক বছরের জন্য যে কোনো অনুষ্ঠান দেখতে পারবেন। এই সদস্যদের মধ্যে চাকরিজীবি, গৃহিণী ও ছাত্ররাও আছেন। যে কেউ মাত্র দুই হাজার ৫০০ টাকা ভাড়ায় হলটিতে অনুষ্ঠান করার সব ধরনের সুবিধা পাবেন।”
নাট্যমঞ্চ তৈরির ভাবনা নিয়ে শাহওনেওয়াজ বললেন, “আমাদের এই দনিয়া এলাকায় উল্লেখযোগ্য মাঠ কিংবা শিশুপার্ক নেই। দনিয়া সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দিবসে আমরা রাস্তার পাশে অনুষ্ঠান করতাম। আমাদের প্রধান দর্শক ছিলেন মা ও শিশুরা।
“নামাজের জন্য যখন দীর্ঘ সময় অনুষ্ঠান বিরতি রাখা হতো; তখন দেখতাম, কি অদম্য স্পৃহা নিয়ে তারা বসে আছেন। রাস্তার পাশে তৈরি অস্থায়ী মঞ্চ থেকে যখন মা ও শিশুদের মুখগুলো দেখতাম নিজেদের অসহায় মনে হতো। ভাবতাম, ওদের জন্য কি কিছুই করার নেই আমাদের? সেই দায়িত্ববোধ থেকেই নাটক কিংবা বিনোদনে জন্য স্থায়ী কোনো কিছু করার চিন্তা করতে থাকি আমরা।”
স্মৃতি হাতড়ে তিনি বললেন, “১৯৯৩ সালে আমরা কয়েকজন মিলে দনিয়া সাংস্কৃতিক জোট গঠন করি। তখন এ অঞ্চলে কোনো প্রভাতফেরি হতো না। আমরা জোটের পক্ষ থেকে একুশ উদযাপন পরিষদ গঠন করে দনিয়া গোয়াল বাড়ি মোড়ে অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করি। প্রভাতফেরির আয়োজন করি।
“সেই প্রভাতফেরিতে বিভিন্ন স্কুলের ছেলেমেয়েরা ফুল দিতে আসে। এ ঘটনায় আমরা স্বার্থক হয়েছি বলে মনে করি। পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রা আমরাই এ অঞ্চলে প্রথম চালু করি। এখন বিভিন্ন স্কুলও এটা করে।”
মঞ্চ তৈরির পেছনে আরো একটি অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন শাহনেওয়াজ।
তিনি বলেন, “দনিয়া এলাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ও কয়েকটি হাইস্কুল আছে। আমরা এখানে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করি। বইমেলার আয়োজন করি। বিভিন্ন দিবসে সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজন করি। সেখানে দর্শকের উপচে পড়া ভিড় থাকে। এমনি একটি উৎসবে আমরা টিকেট কেটে দর্শকদের নাটক দেখানোর ব্যবস্থা করি। বিস্ময়করভাবে অনুষ্ঠানের আগেই সব টিকেট শেষ হয়ে যায়। তখন আমাদের মনে হলো এখানে একটি নাটকের মঞ্চ করাই যায়।”
“দনিয়া স্টুডিও থিয়েটার হলটি করতে আমাদের সাহস জুগিয়েছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা। আমরা যখন তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলি তারা আমাদের উদ্যোগের প্রশংসা করেন। সরকারের কাছ থেকেও আমরা কিছু সহযোগিতা পেয়েছি”, বলেন শাহনেওয়াজ।#