
স্থানীয় কিশোর-কিশোরীরা বিভিন্ন জায়গা থেকে জমিদার বাড়িতে বিকেল কাটাতে ছুটে এসেছে। জেনেসিস থিয়েটারের নূর হোসেন রানা ভাই, ইমন, ইকবাল, সমুদ্র আর আমিও ছিলাম সেদিন। শুকিয়ে যাওয়া ছোট্ট খাল পেরিয়ে জমিদার বাড়ির পেছনের সবুজ ঘাসের মাঠে উঠতেই গোবর দিয়ে বানানো ঘুঁটে চোখে পড়লো।
সূর্য ডুবু ডুবু। ইকবালের ক্যামেরায় পড়ন্ত বিকেলে জমিদার বাড়ির কিছু ছবি তুলে ফেললাম। বেশ পুরনো জমিদার বাড়ি। অনেক জায়গায় ইট খুলে পড়েছে। পলেস্তারা নেই অনেক দেয়ালেই। অযত্নে থাকার ছাপ সবখানে। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই মূত্রের উৎকট গন্ধ নাকে এলো। ছোট পরিসরের দরজা দিয়ে ঘরের ভেতর তাকিয়ে মাটির ঢিবি চোখে পড়লো। অনেকদিন অব্যবহৃত থাকলে এমনটা হয়।
জমিদার বাড়ির সামনের অংশে কাঁটা তারের বেড়া। যা তেমন কোনো কাজে আসে না বলে দেখে মনে হলো। এলাকার লোকজনও একই কথাই বললেন।
স্থানীয় গ্রাম পুলিশ অনন্ত কুমার সরকার আমাদের বললেন, ১৯৮৮ সালের বন্যায়ও এই জমিদার বাড়িটি অনেক খোলামেলা ছিল। পাশের যমুনা নদীর ভাঙনের শিকার হয়ে অনেক পরিবার এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে তারা এই জমিদার বাড়ির মাঠ ও এর আশপাশে বসত গড়ে থাকছিল।
কয়েক বছর আগে সরকার এখান থেকে সবাইকে উচ্ছেদ করে কাঁটা তারের বেড়া লাগিয়ে সাইনবোর্ড টানিয়ে দেয়। এখন আর কোনো পরিবার এখানে থাকে না। এটি দেখভালের জন্য সরকার থেকে একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
জমিদার বাড়ির পশ্চিমে তেওতা ইউনিয়ন পরিষদ, দক্ষিণে তেওতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উপজেলা ভূমি অফিস এবং ঈদগাহ মাঠ। বাড়িটির রক্ষণাবেক্ষণে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরিচালকের পক্ষ থেকে সর্বসাধারণের জন্য সতর্কতামূলক একটি বিজ্ঞপ্তি টানানো হয়েছে।
জমিদার বাড়ির সামনের বিশাল নবরত্ন মন্দিরটি নতুন করে রঙ করা হয়েছে। দেশ-বিদেশের অনেক পর্যটক এই জমিদার বাড়িটি দেখতে আসেন। তবে থাকার জন্য তেমন ভালো কোন ব্যবস্থা নেই বলে জানালেন অনন্ত।
তেওতা জমিদার বাড়িটি মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের প্রাচীন একটি জমিদার বাড়ি ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। এটি উপজেলার তেওতা নামক গ্রামে অবস্থিত। বর্তমানে এই স্থাপনাটির মালিক বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।
বিভিন্ন ইতিহাস থেকে জানতে পারি, ১৭শ শতকে জমিদার পঞ্চানন সেন এই জমিদার বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। যদিও পঞ্চানন সেন এক সময় খুব দরিদ্র ছিলেন তবে দিনাজপুর অঞ্চলে তামাক উৎপাদন করে প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক হওয়ার পর তিনি এই প্রাসাদটি নির্মাণ করেন। তবে পঞ্চানন সেনের পর এখানে জয়শংকর ও হেমশংকর তাদের জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু দেশ ভাগের পর তারা দুজনেই ভারত চলে গেলে বাড়িটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়।
এই জমিদার বাড়ির পাশেই ছিল নজরুলের স্ত্রী প্রমীলা দেবীর বাড়ি। তাই জমিদার বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে কবি নজরুল ও আশালতা সেনগুপ্ত প্রমীলা (দুলি) দেবীর প্রেমের স্মৃতি। প্রমীলার রুপে মুগ্ধ হয়ে নজরুল লিখেছিলে, ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় সেকি মোর অপরাধ’।
প্রমীলা দেবীর বাবা বসন্ত সেনের ভাতিজা বীরেন সেনের সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের পরিচয় সূত্রে প্রায়ই তাদের বাড়িতে যাতায়াত ছিল। এভাবেই প্রমীলা দেবীর সঙ্গে নজরুলের প্রেম। নজরুল অনেকবারই তেওতা এসেছেন; থেকেছেন। লিখেছেন ছোট হিটলার, হারাছেলের চিঠি, ইছামতি, লিচুচোরসহ অনেক কবিতা, গান ও কীর্তন। ছোট হিটলার কবিতায় কবি বলছেন, ‘‘ভয় করি না পোলিশদের জার্মানির ঐ ভাওতাকে/ কাঁপিয়ে দিতে পারি আমার মামার বাড়ি তেওতাকে…।’’
‘কুহেলিকা’ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট এখানে বসেই রচনা করেছেন নজরুল। জমিদার বাড়ির কাছে যমুনা নদীর সৌন্দর্য দেখে কবি লিখেছিলেন ‘আমার কোন কূলে আজ ভিড়লো তরী…’।
পর্যটকদের থাকা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা এবং জমিদার বাড়ির অন্দর মহলকে সুসজ্জিত করে পুরাকীর্তির এই স্থানটিকে আকর্ষণীয় করে তোলা এখন সময়ের দাবি। সরকার এ দিকটায় আরো মনযোগী হলে ঢাকার অদূরের এই তেওতা জমিদার বাড়িটি হতে পারে পর্যটকদের জন্য এক দারুণ আকর্ষণীয় স্থান।