ছোট গল্প আমার কথা গল্পকার মনি রায় ঘোষ
"ছোটবেলা থেকেই আমি একটু সাহিত্য প্রেমী।যেকোন ধরনের গদ্য পদ্য দেখলেই জল দিয়ে গিলে খেতে ইচ্ছে করতো।কারো বাড়িতে গেলে যদি পছন্দের লেখকের বই দেখতাম তাহলে হ্যাংলার মত চেয়ে নিয়ে আসতাম।যদি না দিত তাহলে চুরি করে নিয়ে আসতাম।।।পড়ে আবার সময়মত ফেরতও দিয়ে আসতাম।একদম ই অভদ্র চোর ছিলাম না।একদিন পড়ার বই এর মধ্যে লুকিয়ে গল্পের বই পড়তে গিয়ে কাকিমার কাছে ধরা পড়ে গেছিলুম।সে বাপু এক কেলেঙ্কারি কান্ড হয়েছিল বটে।সেত প্রায় কান ধরে আমার মাতৃ দেবীর কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত।
যাই হোক পায়ে ধরে কান্নাকাটি করে সে যাত্রা রক্ষা পেয়েছিলাম বটে।তবে সেই অভ্যাস টা কিন্তু ছিলই।শুধু আরেকটু সতর্ক হতে হয়েছিল এই যা।
লুকিয়ে লুকিয়ে গল্পের বই কবিতার বই পড়ার অপরাধে কত যে মার খেয়েছি মা এর কাছে তা আর মনে না করাই ভাল।আসলে পড়া লেখাতে কোন কালেই বাবা মা কে খুশি করতে পারিনি আমি।কোনদিনই তাদের পছন্দ মত রেজাল্ট করতে পারিনি তাই একরকম বাধ্য হয়েই বোধহয় মা আমার সাহিত্য প্রেমের বিরুদ্ধা চারন করত।আমি বুঝতাম সেটা।কিন্তু কি করতাম।ওই পড়া শুনা নামক ব্যাপারটা আমার কাছে বরাবরেরই অপ্রিয় বিষয়বস্তু ছিল।তা আর কে বুঝত।কাকেই বা বোঝাতে পারতাম।
একটু বড় হতে নিজেই কলম ধরলাম কবিতা লেখার চেষ্টায়।লিখতাম ও হিজিবিজি।সেসব কবিতা হত কিনা সেটা বলা মুশকিল।আমার এক মাষ্টার মশাই ভাল কবিতা লিখতেন।তার পর থেকে ওনাকেই আমার কবিতার গুরু ভাবতে শুরু করলাম।সেটা অবশ্য ওনার অজান্তেই।রোজ একখানা হিজিবিজি লিখে ওনার হাতে ধরিয়ে দিতাম।উনি ভুল ত্রুটি শুধরে দিতেন।উনিও মনে মনে এই কাজখানা ওনার ডিউটির মধ্যেই ফেলেছিলেন যদিও এর জন্য আলাদা কোন মাইনে দেয়া হতনা।তবুও উনি আগ্রহের সহিত এই কাজখানা করতেন।
আমার পরিবারে দুর দুর পর্যন্ত তাকালেও একজন সাহিত্য প্রেমী খুজে পাওয়া যাবে না এটা আমি হলফ করে বলতে পারি।ছোটবেলায় অবশ্য মা কে গল্পের বই পড়তে দেখতাম।আমার এক দুর সম্পর্কের মামা ছিলেন যিনি কড়া দামে গল্পের বই ভাড়া দিতেন।মা কে দেখতাম ওনার কাছ থেকে বই ভাড়া করে এনে পড়ত।সন্ধ্যে বেলা মা আমাকে পাড়া থেকে কুড়িয়ে নিয়ে আসত।গায়ের ধুলো কাদা ঝেড়ে মানুষের রুপ ফিরিয়ে পড়তে বসাত।আর তখন মা ও গল্পের বই নিয়ে বসত ঠিক আমার পাশটিতে।একেই তো নাচুনি বুড়ি তার মধ্যে আবার ঢোলের বাড়ি।নাচতে তো ইচ্ছে জাগবেই।আমার আর কি দোষ।কিন্তু মা সেটা বুঝলে তো।মা তো সময় কাটানোর জন্য কড়া দামে বই আনত যাতে আমাকে পড়াতে অধর্য না হতে হয়।কিন্তু ওই গল্পের বই এর মধ্যেই যে আমার প্রেম লুকিয়ে আছে সেটা মা বুঝবেই বা কি করে।
আমি সেই ছোটবেলা থেকেই তাসলিমা নাসরিন এর অন্ধ ভক্ত।ওনাকে মনে মনে গুরু মেনে এসেছি বরাবরই।ওনার মত বাস্তববাদী লেখিকা আমি আজ অবধি খুব কমই দেখেছি।সারাজীবন উনি মেয়েদের সন্মান নিয়ে ভেবেছেন।ওনার লেখার মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছেন।তার জন্য ওনাকে অনেক অপমান লাঞ্ছনা সইতে হয়েছে।দেশ থেকে পর্যন্ত তারিয়ে দেয়া হয়েছে।এত কিছুর পরেও উনি ওনার কলম থামান নি।প্রতিবাদ বন্ধ করেন নি।নিজের জায়গা থেকে এক চুল নড়েন নি।
আমার বাবা মাঝে মধ্যে ওনার বই নিয়ে আসত হাতে করে দু এক খানা মা এর জন্য।আমি ওগুলো লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তে গিয়েও কম পিঠ ফোলাই নি।যাই হোক সেসব এখন অতীত।ভাগ্য টা বরাবরই আমার এমনি উল্টো।
বিয়ে করলাম একজন ঘোর অসাহিত্যিক কে।
যিনি কোনদিনই ধর্য ধরে একখানা গল্প পড়ে শেষ করতে পারেন নি।আর ওনার কাছে এটা খুবই আশ্চর্যের যে কেউ কি করে গল্পের বই এর মধ্যে মুখ গুঁজে বসে থাকতে পারে।তাই আমিও এনার কাছে বেশ আশ্চর্যেরই বটে।
অবশ্য এসবে আমার দুঃখ নেই কোনকালেই।
যা লিখি যা পড়ি তা আমার একান্ত আপনার।আমার বেচে থাকার শক্তি ।
কেউ পড়ল কিনা কেউ দেখল কিনা তা নিয়ে মাথা ব্যাথা খুব একটা হয়না।আমি আমার কথা লিখি।রাগ হোক কিংবা আনন্দ।আমার সবেতেই ছন্দ।
যা আমি মুখে বলতে পারি না তা আমার কলম বলে।আমার সবথেকে কাছের বন্ধু আমার কলম।