ছোট গল্প -তুমি আমার আপন মানুষ যে..
লেখক-:
জাকওয়ান হুসাইন
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুপুরটা আজ কেমন যেন বিষন্নতায় ভরা। সময় যেন থমকে দাঁড়িয়েছে। সকাল থেকে বেশ কয়েকটা লাশ এসেছে এ পর্যন্ত। চারদিকে অসংখ্য পুলিশ আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে সকাল থেকেই রাস্তায় ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। সরকারের অগনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে রাজপথে নেমে এসেছিল অসংখ্য ছাত্র তরুণ। মিছিলে পুলিশের হামলায় নিহত হয় অনেকেই। ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সুদীপ্ত শাহরিয়ার সকাল থেকে ব্যস্ত লাশগুলোর পোষ্ট মর্টেম করা নিয়ে। আজ তার মন ভাল নেই। তার দীর্ঘ চিকিৎসক জীবনে বহু লাশের পোষ্টমর্টেম করেছেন। একটুও খারাপ লাগেনি। কিন্তু আজ তার নিপুন অভ্যস্ত হাতটা কেন যেন কাপছিল এই তরুণদের শরীরের ছুড়ি কাচি চালাতে। ৬টা লাশের পোষ্টমর্টেম শেষ করে ৭ নম্বরটার কাছে যেতেই প্যান্টের পকেটে অর্ধেক বের হয়ে আসা একটা মানিব্যাগ দেখতে পায়। অ্যাটেনডেন্টকে দেয়ার জন্য মানিব্যাগ তুলতেই একটা সাদা কাগজ দেখতে পায় মানিব্যাগে। কৌতুহলবশত কাগজটা খুলতেই বুঝতে পারে এটা একটা চিঠি। মনে পড়ে যায় আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর সেই বিখ্যাত কবিতার কথা। এক ভাষা শহীদের পকেটে পাওয়া মায়ের কাছে লেখা সেই রক্তে ভেজা চিঠিটার কথা। কৌতুহল বেশ ভালই পেয়ে বসে ডা.সুদীপ্ত শাহরিয়ারকে। পকেটে রেখে দেয় চিঠিটা। পোষ্টমর্টেম শেষ হতে হতে রাত হয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট সব কাজ শেষ করে যখন বাসায় ফেরে তখন মাঝরাত। কোন রকম ফ্রেশ হয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে বেতের চেয়ারে বসে পড়ে চিঠিটি পড়ার জন্য। এখন কৃষ্ণপক্ষ চলছে। আকাশে চাঁদ নেই। আছে অগুনতি তারকারাজি। ব্যালকুনিতে বসতেই জোরে একটা দমকা হাওয়া ভেসে আসলো। বৃষ্টিও আরম্ভ হয়ে প্রায় সাথে সাথেই। ব্যালকনিতে টবে লাগানো হাস্নাহেনা গাছ থেকে মাতাল করা সুবাস আসছে। ডা.সুদীপ্ত অচেনা সেই যুবকের চিঠিটা পড়ার জন্য চোখের সামনে মেলে ধরে। পড়তে শুরু করে চিঠির লেখা…..
প্রিয়তমা, ভাল আছ কি না জানি না। তবে ভাল থেকো এই প্রার্থনাই সবসময় করি। তোমাকে আবারও চিঠি লেখবার ইচ্ছে হলো। জানি এই চিঠিটাও তোমার কাছে পৌছবে না। আমি পৌছানোর কোন চেষ্টাই করবো না। মানিব্যাগে রেখে দেব। বরাবরের মতো আবার কিছুদিন পর টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলবো। তোমাকে চিঠি লেখা আর ছিড়ে ফেলা এক অদ্ভুত খেলা আমার কাছে। এবার কিন্তু অনেকদিন পর চিঠি লিখছি। কোন একটা কাজে পল্টনে এসেছিলাম। ফেরার পথে শাহবাগের কাছে আসতেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। বৃষ্টিতে আমার বড্ড তোমার কথা মনে পড়ে। তাই পরিবাগের একটা বারে চলে আসলাম। এখানে বসেই চিঠিটা লিখছি। আলো আধারের ছায়া আর সিগারেটের ধোয়ায় একটা অপার্থিব পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে কামরাটায়। দীর্ঘদিনের পরিচিত ওয়েটারের কাছে যখন কাগজ আর কলম চাইলাম সে বেশ অবাকই হলো। বারে এসে সচরাচর কেউ কাগজ কলমের খোঁজ করে না। তার তো অবাকই হবার কথা। যাইহোক,হুইস্কির সাথে বেনসন সিগারেট সবসময়ই স্বর্গীয় সুখ অনুভব করায়। তুমি যদি চিঠিটা কখনো পড়তে বেশ অবাকই হতে তাই না? আমি তো তোমার ভয়ে সিগারেটও খেতাম না। কিরকম একটা হাস্যকর ব্যাপার ছিল বলো তো? কি ভয়টাই না পেতাম তোমায়। চির অগোছালো আমি তোমার ভয়ে তোমার করে দেয়া রুটিন মাফিক চলতাম। রাতের প্রথম প্রহরে ঘুমোতে যাওয়া,ভোরে ওঠা সহ সব কাজ রুটিন ধরে ধরে করার অভ্যাস করিয়ে দিয়েছিলে। বেশ ভালই লাগতো কিন্তু। আর এখন দেখো! কতটা বদলে গেছি। তুমিই তো বলেছিলে, তোমার বিকল্প খুজে নিতে। বিশ্বাস করো অ্যালকোহল,নিকোটিন আর নির্ঘুম প্রত্যেকটি রাতের চাইতে ভাল কোন বিকল্প পাইনি আমি। তোমার বিকল্প হিসেবে এসব কিন্তু খুব একটা খারাপ না! আমাকে বেশ ভালই বাঁচিয়ে রেখেছে।
সূর্য কতবার উদিত হয়ে পশ্চিমে অস্ত গিয়েছে,চাঁদ তার মাসিক সফর শেষ করেছে অসংখ্যবার,লাখোবার ভোরের আলোয় আত্মগোপন করেছে রাতের অন্ধকারে দীপ্তি ছড়ানো সিতারার দল। কত লক্ষ মূহুর্ত পার হয়ে গেছে তোমাকে না দেখার। তবুও তো বেঁচে আছি। আর বেশ ভালই তো আছি। চাওয়া পাওয়ার হিসেবগুলো আমার সব মিটে গেছে।
সেদিন পাহাড়ে গেছিলাম। একদিন তুমি আমি যেখানে একসাথে বসে নেকড়ে পূর্ণিমার চাঁদ দেখেছিলাম একসাথে সেই জায়গায় বেশ কিছুক্ষন সময় কাটিয়েছি একা একা। আমার না হাসি পাচ্ছিলো। কত না পাগলামি আর ছেলেমানুষি করেছিলাম দুজন মিলে। জানো সেদিনও বৃষ্টি হয়েছিল। তোমার আমার সবকিছুতেই বৃষ্টির অংশগ্রহণ যেন একটা নিয়ম ছিল। তোমাকে পাওয়া থেকে শুরু করে বিচ্ছেদের দিনটাতেও বৃষ্টি হাজির হয়েছিল তার স্বমহিমায়। প্রথম চুমু খাওয়া,প্রথম হাত ধরা সবদিনই কিন্তু বৃষ্টি স্বাক্ষী ছিল আমাদের। থাক স্মৃতিচারণ আর না করি। চিনচিনে কেমন যেন একটা ব্যথা অনুভূত হয়ে বুকে স্মৃতিচারণে।
শুনলাম তুমি নাকি তুমুল সংসারী হয়েছ? অথচ একদিন আমরা সন্যাস নেয়ার প্ল্যান করেছিলাম। হাহাহা। আমি পুরো সন্যাসী না হলেও আধা সন্যাসী কিন্তু আমাকে বলায় যায়। হিহিহি। আমি কিন্তু বেশ ভালই আছি। কখনো আমার কথা ভেবে অপরাধবোধে ভেবো না। পারলে আমাকে অনেকখানি ঘৃণাই করিও। অন্তত অপরাধবোধ থেকে বাঁচবে তাহলে। তোমার প্রতি আমার কিন্তু কোন রাগ,অভিমান বা অভিযোগ নেই। তুমি আমায় অনেক দিয়েছ। যা আমার মতো অভাগার পাবার যোগ্যতা ছিল না। তোমার মনে আছে? এক বিকেলে দখিনা আকাশে একখন্ড কালো মেঘ দেখিয়ে বলেছিলাম, দেখেছ নৈঃশব্দবতী দখিনা আকাশে মৃত্যুর ছায়া আঁকা আছে, একদিন আমিও ছায়া হবো তুমি ছবি এঁকো..
আমি কিন্তু সত্যিই ছায়া হয়ে গেছি নৈঃশব্দবতী। শুধু মৃত্যুটুকুই বাকী। জানো,অনেকেই অনেকরকম প্রশ্ন করে। কিন্তু আমি চুপ করে থাকি। চোখের নীচের কালো দাগ দেখে আড়ালে আবডালে অনেকে বাজে কথা বলে। তাদের কি করে বুঝাই বলো তো! আমি রাতে ঘুমুইনা কারণ তোমাকে কথা দিয়েছিলাম যে তোমাকে ঘুম না পাড়িয়ে আমি ঘুমুবো না। তোমাকে দেয়া কথা কি আমি না রেখে পারি বলো? এখন তো আমি জানি না তুমি ঘুমাতে পারো না কি না। তাই জেগে থাকি সারাটি রাত্রি ধরে। আমার কিন্তু কোন কষ্ট হয় না। আমি এখনো তোমাকে ঈশ্বরের দৃষ্টিতে দেখি। বিশ্বাসের জায়গায় আমার কাছে তোমার অবস্থান ঈশ্বরের থেকে বেশি কাছাকাছি…
তোমাকে আজ অনেক কিছুই লিখতে ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু হাত কাপছে। ঝাপসা হয়ে আসছে চোখের দৃষ্টি। হুইস্কি তার প্রভাব শুরু করেছে আমার উপর। অথচ একদিন প্রভাব শুধু তোমারই ছিল। ভালই থেকো প্রিয়তমা। আর হা আমি এখনও তোমাকে ভয় পাই। তাই এই অগোছালো জীবনের খবর লুকিয়েই রাখতে চাই। বরাবরের মতো এই চিঠি কিছুদিন পকেটবন্দী হয়েই থাকবে। পরে আবার কোন এক বৃষ্টির দিনে হয়তো টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলবো। আবার হয়তো নতুন করে লিখবো কোন একদিন।
দখিনা হাওয়ায় সেদিনই মৃত্যুর গন্ধ পেয়েছিলাম যখন তোমার আমার বিচ্ছেদ ঘটেছিলো সময় আমাকে একটি চিরস্থায়ী মৃত্যু উপহার দিয়েছে তোমার বিচ্ছেদের প্রতিটি সেকেন্ড,আমার একেকটি মৃত্যু মুহুর্ত।
সব শেষ হয়ে যায়। হৃদয়ে থেকে যায় শুধু তোমার নাম। তুমি আমার আপন মানুষ যে…..
চিঠি পড়া শেষ হয়। কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে থাকে ডা,সুদীপ্ত। বাইরে বৃষ্টির বেগ আরো বেড়ে গেছে। জলের ছাট এসে ভিজে গিয়েছে শরীরের একপাশ। পাশ থেকে সিগারেটের প্যাকেট টা হাতে নিয়ে একটা সিগারেট ধরায়। তারপর এসে দাঁড়ায় গ্রিলের কাছে। টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলে চিঠিটা। চোখের সামনে তার ভেসে ওঠে লাশকাটা ঘরে রাখা সেই অচেনা প্রেমিকের ছবি। বৃষ্টির বেগ বাড়তেই থাকে……