রবিবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

জন্মাষ্টমী ও শ্রীকৃষ্ণের জন্মকথা

গোষ্টলাল দাস:

'কৃষ্ণ' শব্দটি 'কৃষ্' এবং 'ণ' এই দুটি মূল থেকে উৎপন্ন। 'কৃষ্ণ' শব্দটির সংস্কৃত অর্থ হলো-কালো, ঘন বা ঘন-নীল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথিকে কেন্দ্র করেই শুভ জন্মাষ্টমী পালন করা হয়। জন্মাষ্টমীকে কৃষ্ণাষ্টমী, শ্রীকৃষ্ণ জয়ন্তী, গোকুলাষ্টমী ও অষ্টমী রোহিণী প্রভৃতি নামেও ডাকা হয়। জন্মাষ্টমী উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন মন্দিরে পূজা অর্চনা, তারকব্রহ্ম হরিনাম সংকীর্তন ও তারকব্রহ্ম নামযজ্ঞেরও আয়োজন করা হয়। ঘরে ঘরে ভক্তরা উপবাস থেকে জন্মাষ্টমীতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা ও পূজা, গীতাযজ্ঞ, জন্মাষ্টমী মিছিল, কৃষ্ণপূজা, পদাবলি কীর্তন করে থাকেন।

শাস্ত্রীয় বিবরণ অনুযায়ী, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দ্বাপর যুগে ৩২২৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ১৮ অথবা ২১ আগস্ট বুধবার ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে যাদব(যদু) বংশে জন্মগ্রহণ করেন (মৃত্যু বরণ: খ্রিস্টপূর্ব ৩১০২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি)। দ্বাপরযুগের এইদিনে পাশবিক শক্তি যখন সত্য, সুন্দর ও পবিত্রতাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছিল, তখন সেই অসুন্দর, অসুর ও দানবীয় পাশবিক শক্তিকে দমন করে মানবজাতিকে রক্ষা এবং শুভশক্তিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটেছিল পূর্ণ অবতার রূপে। মানবরূপের পৃথিবীর আবির্ভাবের কারণ সম্পর্কে গীতায় তিনি বলেছেন-
 ''যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানি ভবতি ভারত।
 অভ্যুত্থানম ধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।।
 পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
 ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভাবামি যুগে যুগে।"
             (জ্ঞানযোগ:৭/৮)
(হে ভবত, যখনই পৃথিবীতে অধর্ম বেড়ে যায় তখন আমি অবতীর্ণ হই, অবতীর্ণ হয়ে সাধুদের রক্ষা, দুষ্টের বিনাশ ও ধর্ম সংস্থাপন করি।)

হিন্দু পঞ্জিকা মতে, সৌর ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে যখন রোহিণী নক্ষত্রের প্রাধান্য হয়, তখন জন্মাষ্টমী পালিত হয়। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার মতে, প্রতিবছর মধ্য আগস্ট থেকে মধ্য সেপ্টেম্বরের মধ্যে কোনো এক সময়ে এ উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এ বছর তেসরা সেপ্টেম্বর ২০১৮ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী পালন করা হচ্ছে।

উগ্রসেন নামে মথুরার এক রাজা ছিলো। রাজা উগ্রসেন ছিলেন খুবই ধার্মিক। কিন্তু রাজা ধার্মিক থাকলে কি হবে, তাঁর ছেলে কংস ছিল খুবই অত্যাচারী এবং পাষ-। কংসের অত্যাচারের মাত্রা এতটাই বেশি ছিল যে নিজের পিতা উগ্রসেনকেও সিংহাসনচ্যুত এবং কারাবন্দী করে নিজেই সিংহাসনে বসে এবং মথুরায় রাজত্ব করে। আবার এই কংসই আরাধনা করে বর লাভ করেছিল, তার বোন দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান ছাড়া অন্য কোনো ভাবে তার মৃত্যু হবে না। এজন্যই কংসের অত্যাচারের মাত্রাটাও এত বেশি ছিল।

দেবকীর বিবাহ হয় যদুবংশীয় শূরসেনের পুত্র বসুদেরে সাথে। বর-কনেকে রথের উপর বসানো হয়েছে এবং রথের সারথি হচ্ছে কংস। রথ চলছে এমন সময় হঠাৎ করে সেই দৈববাণীটি কংসের কানে বেজে উঠলো, "ওরে নির্বোধ যাকে তুমি রথে করে নিয়ে যাচ্ছো তার গর্ভের অষ্টম সন্তান তোমার প্রাণ হরণ করবে।" দৈববাণী শুনে কংস সঙ্গে সঙ্গে খড়গ হাতে দেবকীকে হত্যা করার জন্য উদ্যত হলো। এ দেখে বসুদেব কংসকে অনেক সবিনয় অনুরোধ করে রাজি করালো এই বলে যে, তাদের সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরই কংসের হাতে সোপর্দ করা হবে। একথা শুনে কংস শান্ত হলো ঠিকই, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দেবকী বসুদেবকে কারাগারে নিক্ষেপ করলো।
মাঝখানে কেটে গেল অনেক বছর। একে একে জন্ম নিলো ছয়টি সন্তান। ছয়টি সন্তানকেই একেক করে কংস নিজ হাতে হত্যা করে। সপ্তম গর্ভের সন্তান যখন বলদেব অধিষ্ঠিত হয়েছিল তখন ভগবানের নির্দেশে যোগমায়া দেবী দেবকীর গর্ভ হতে তাকে স্থানান্তরিত করে নন্দালয়ে রোহিণীর গর্ভে স্থাপন করে এবং প্রচার করা হয় দেবকীর গর্ভপাত হয়েছে।

এবার অষ্টম গর্ভের সন্তান অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মগ্রহণ করার পালা। কারাগারের বাইরে পূর্বের চেয়ে কংস এবার আরও বেশি পাহারার ব্যবস্থা করলো। মাস ছিল ভাদ্র, তিথি ছিল অষ্টমী এবং রজনী ছিল ভীষণ দুর্যোগময়। প্রবল ঝড়-বৃষ্টিতে প্রকৃতি ধারণ করে এক অন্য রবম মূর্তি, বিদ্যুৎ উচ্ছ্বলিত ঠিক এমন সময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দেবকীর গর্ভে আবির্ভূত হন এবং দৈববাণী শোনা যায়, "বসুদেব, তুমি এখনই গোকুলে যেয়ে নন্দের স্ত্রী যশোদার পাশে তোমার ছেলেটিকে রেখে এসো এবং এই মুহূর্তে তার যে কন্যা শিশুটি জন্মগ্রহণ করেছে তাকে এনে দেবকীর কোলে শুয়ে দাও। আমার মায়ায় পৃথিবীর সমস্ত মানুষ এখন গভীর ঘুমে অচেতন, যার ফলে কেউ কিছই জানতে পাবে না।" সঙ্গে সঙ্গে শিশুটিকে নিয়ে বসুদেব ছুটতে লাগলো নন্দের বাড়ির দিকে। পথে যমুনা নদী। বর্ষাকাল তাই যমুনা কানায় কানায় পরিপূর্ণ ছিলো। তখন বসুদেবের নিরুপায় মনে হলো। হঠাৎ করে বসুদেব দেখলো যমুনার জল শুকিয়ে গিয়েছে এবং একটা শৃগাল যমুনা নদী পার হয়ে যাচ্ছে। বসুদেব তখন ঐ রূপধারী শৃগালকে পথ প্রদর্শক মনে করে তার পেছনে পেছনে হাঁটতে লাগলো। এমন সময় প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। বসুদেব ও শ্রীকৃষ্ণকে বৃষ্টি থেকে রক্ষা করার জন্য নাগরাজ তার বিশাল ফণা বিস্তার করলো তাদের মাথার উপরে। কিছু সময়ের মধ্যে বসুদেব তার ছেলেকে যশোদার কোলে রেখে যশোদার কন্যা যোগমায়াকে নিয়ে কংসের কারাগারে ফিরে এল।

সকাল বেলা কংস খবর পেল দেবকীর অষ্টম সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে কারাগারে চলে এসে দেবকীর কোল থেকে মেয়েটিকে ছিনিয়ে নিয়ে পাথরের উপরে আছাড় মারতেই মেয়েটি শূন্যে উঠে যেয়েই যোগমায়া মূর্তি ধারণ করে। মহাশূন্যে মিলিয়ে যাওয়ার পূর্বে কংসকে বলে গেলো, "তোমাকে বধিবে যে গোকুলে বেড়েছে সে।" এই কথা শুনে কংস মথুরার সকল শিশুকে মারার পরিকল্পনা করে। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি।কংস কৃষ্ণকে অনুসন্ধান করে হত্যা করার অনেক চেষ্টা করেন, কিন্তু সব ব্যর্থ হয়ে যায়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কংসকে বধ করে মাতামহ উগ্রসেনকে সিংহাসনে বসিয়ে মথুরা তথা পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথিতে অকল্যাণ, অমঙ্গলের সবকিছুর চিরবিদায় নিয়ে শান্তি বর্ষিত হোক এটাই আজকের প্রার্থনা।

গোষ্টলাল দাস
প্রভাষক(বাঙলা),দৌলতকান্দি গার্লস কলেজ
রায়পুরা, নরসিংদী।


Share: