সোমবার, ৪ মার্চ, ২০১৯

ছোট গল্প- আমি মিন্টু বলছি - শ ফি ক ন হো র


আমাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা চারজন, আমার একবোন,মা-বাবা । বাবা প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার, মা সংসারের কাজ নিয়ে ব্যস্ত । ছোট বোনটার বিয়ে হয়ে গেছে ।মা’ সারাদিন একা বাড়িতে থাকে । বাবা স্কুল থেকে এসে ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট পড়ায়, ‘বাড়তি কিছু টাকা সংসারে যোগ হয়, ‘ মা’ চাইত আমার বিয়ে দিয়ে তারা, সুখে — শান্তিতে বাকি দিনগুলি অতিবাহিত করবে ।বাবা কখনো আমাকে বলেনি খোকা, তোর জন্য মেয়ে দেখছি; বা আমাদের ঘরে একটা বউ দরকার । আমি রাত করে বাড়ি ফিরতাম; বলে বাবা আমার প্রতি ভীষণ নারাজ, মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিতেন । আমার ভীষণ রাগ হত । আমি রাতে একাকী খুব কান্না করতাম । মা বুঝতে পারত;তবুও কিছুই বলতো না ।

আমি কিছুদিন পরে রাগ করে বাড়ি থেকে চলে যাই । মা’বাড়ি থেকে যাবার দিন, আমাকে একবার ও বললো — না, খোকা তোর বাবা রাগ করে না হয়;কথা গুলো বলেছে-তুই বাড়ির ছেলে, বাড়িতে থাক । মা’ নিবর ভূমিকা পালন করলো । আমার অভিমান আরও কঠিন হতে লাগলো । মনে -মনে শতবার বলেছি, তোরে মরে গেলেও কোনদিন এ বাড়িতে আসব — না ।আমি সকালে উঠে চলে আসলাম নগরবাড়ি ঘাটে,সেখান থেকে নৌকা যোগে ঢাকা ।

হাকিম বিশ্বাসের ছেলের মারফত গার্মেন্টসে একটা চাকরি হলো আমার তাও অনেক কষ্টে ।
প্রথম দিন অফিসে এসেই ধাক্কা খেলাম । সুপারভাইজার যাচ্ছে তাই বলে বকাবাজি করতে লাগলো । গার্মেন্টস না কি পতিতালয়,বুঝে ওঠার আগেই নাজমা, নামের একটা মেয়ে বললো ভাই । এখানে সবার সঙ্গে বাজে আচরণ করা হয় । কেউ কিছুই বলে না । মুখ থেকে কোন কথা বের হলে সোজা গেট দিয়ে চলে যেতে হবে । অবাক হলাম ! এই পরিবেশ গার্মেন্টসে । ‘যাব কোথায় ?' বাড়ি থেকে তো রাগ করে চলে এসেছি । ‘ভাগ্যে যা আছে —তাই  হবে ?'এভাবেই কেটে গেল, আলিফ গার্মেন্টসে দু’বছর । বাড়ি থেকে কেউ আমার খোঁজখবর নেয়নি । আমি তো মনে-মনে ভেবে নিয়েছি;এ পৃথিবীতে আমার আপনজন  বলে কেউ নেই । কেউ যখন জিজ্ঞাসা, করত ভাই আপনার পরিবারে কে -কে আছেন ? বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠত ।মিথ্যে করে বলতাম, ‘কেউ নেই আমার, । নিজেকে সুখী মানুষ মনে হত তখন ।চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল ,আমি পাশের পুরাতন কাপড় দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে সেখান থেকে চলে গেলাম ।

রাতে মায়ের জন্য খুব কষ্ট হত । মাকে ভীষণ মনে পড়ত । চাপা অভিমানে মাকে ভুলে গেলাম ।মীরা ,তখন আমার স্ত্রী । আমাকে মাঝে মধ্যে প্রশ্ন করত ।তোমার বাবা’ মায়ের জন্য মসজিদে শুক্রবার মিলাদ দিতে পার । ‘মানুষ বাবা মায়ের জন্য কত কি করে , তুমি না— তোমার বাবা মায়ের এক মাত্র সন্তান । আমার বুকের পাঁজর টা তখন ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায় । মা"তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও । রঙিন স্বপ্নের মোহ মায়ায় সব কিছু অবলীলায় ভুলে আছি ।পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন আমি ।

বাবা আগের মত টিউশনি করাতে পারে না,সংসারে অভাব,মা' প্যারালাইজড দু'বছর হল । মা' আমাকে বাড়ি যেতে বলেছে; গজেন মাঝি সন্ধ্যায় নৌকা ছেড়ে দিবে ।
আমি গজেন চাচাকে আশ্বস্ত করলাম, কাকা আমি দু'একদিনের মধ্যে বাড়ি যাবো;আপনি বাবাকে বলবেন ।পাটের নৌকা নাজিরগঞ্জ ঘাটে রেখে আগে তোমাদের বাড়ি সংবাদ দিয়ে, তারপর  আমি বাড়ি ফিরব চিন্তা কর না ।

আমি বাড়ির জন্য কিছু কিনে দিতে চাইলাম ! গজেন মাঝি বলল- মিন্টু তোমার মা' তোমাকে দেখতে চেয়েছে ।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি যেতে বলছে । আমার সাত বছরের ছেলে সোহান, দাদা দাদিকে কখনো দেখেনি । বউকে বাসায় এসে বললাম , ‘আমরা আগামিকাল গ্রামের বাড়ি যাব ।'বউ পুলকিত হল । সারারাত ঘুম আর চোখে আসলো না ।ভোর রাতে অপ্রত্যাশিত ম্যানেজার স্যারের ফোন আলিফ গার্মেন্টসে আগুন লেগেছে। ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছে । আমার বাড়ি যাওয়া হল না । গ্রামের বাড়ি থেকে কে — যেন ফোন করেছিল; আমি মিন্টু বলছি, কত বার একই কথা ।ওপর পাশ থেকে কি ভেসে আসছে কিছুই বুঝতে পারছি না ।  মানুষের  কান্নার আহাজারিতে কানে কিছুই ঢুকছে না।বিকট শব্দে কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম না তখন । সে ফোন টা ছিল আমার বাবার পৃথিবী ত্যাগের কলিং-বেল ।


মা'বাবার লাশ ছুঁয়ে শপথ নিয়েছে আমার মুখ দেখবে না । পরের সপ্তাহে গজেন মাঝির সঙ্গে দেখা ।চাচা আমার দেখে মুখ ফিরেয়ে নিলেন । চাচা কেমন আছেন । কে আপনি ? আমি !আপনাকে চিনতে পারছি না । গজেন কাকা, আমি মিন্টু । আমাকে চিনতে পারছেন না । সত্যি করে বলেন, আমাকে চিনতে পারছেন— না । আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে । তোকে চিনলে তোর বাপের আত্মা কষ্ট পাবে রে মিন্টু ।‘ বুকের ধন কী এত টা হারামি হয়। 'তুই এমন হারামি রে মিন্টু তোর মৃত বাপের লাশটা দেখতে গেলি না ।তোর মা"যতটা না কষ্ট পেয়েছে তোর বাবার চলে যাওয়াতে তার চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছে তার না যাওয়াতে । তুই চলে যা মিন্টু আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ।

মা"শোকে পাথর হয়ে গেছে । মা কানে শুনতে পায় না । যখন মা- মা- মা বলে ডাকলাম মা" কোন সারা শব্দ দিল না । চোখে দেখে না । মা"আমি মিন্টু বলছি;
দেখ তোমার বউ মাকে নিয়ে এসেছি ! মা"সোহান তোমার নাতি ।মায়ের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল । আমার সঙ্গে মা"কখনো কথা বলেনি অভিমানে ….!
Share: