এবছর স্বাধীনতা যুদ্ধের ৪৭ বছর পূর্ণ হয়েছে গতকাল। গোটা দেশজুড়ে মহাসমারোহে উদযাপিত হয়েছে বিজয় দিবস। প্রতিবছরই ঠিক্যেমনটি হয়ে থাকে। উন্নয়নের ঢামাঢোল আর মুক্তিযুদ্ধে শাসকদলের কৃতিত্ব প্রচারে ব্যস্ত ছিল রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমসহ সমস্ত গণমাধ্যম। এই প্রচারের জৌলুস এড়িয়ে কেউ চোখ রাখেছিল কি সত্যিকারের ইতিহাসের দিকে?
গত ৪৭ বছরে যারাই ক্ষমতায় এসেছে — নিজেদের মত করে সাজিয়েছে ইতিহাসের বয়ান। তাদের সেই কীর্তিস্তম্ভে চাপা পড়েছে এদেশের শ্রমিক-কৃষকের কণ্ঠস্বর। যে হাড়জিরজিরে কৃষক-শ্রমিক একদিন নেংটি পড়ে জীবন মৃত্যু তুচ্ছ করে ঝাপিয়ে পড়েছিল স্বদেশকে মুক্ত করার ব্রতে, যে ছাত্র একদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর তথাকথিত ভবিষৎ ক্যারিয়ারের স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে জীবন আহুতি দিয়েছিল দেশবাসীর স্বপ্নপূরণে — আজকে বিজয় দিবসের সভায়- স্লোগানে তাদের নাম নেই, তাদের স্বপ্নের কথা সেখানে আর উচ্চারিত হয় না। ঘর-বাড়ি, বাবা-মা, প্রিয়জনের সান্নিধ্য ছেড়ে কোন্ স্বপ্নে তারা জীবন বাজি রেখেছিল?
পাকিস্তানি প্রায়-ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণে প্রাণ ওষ্ঠাগত শ্রমিক চেয়েছিল এমন একটি দেশ — যেখানে মানবিক জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সে সংগ্রহ করতে পারবে এমন মজুরি, কৃষক চেয়েছিল— তার শ্রমে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম সে পাবে, বারো মাস খাবার জুটবে, সন্তানের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারবে। ছাত্ররা চেয়েছিল — একটি মানুষও যেন শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, অর্থের প্রাচীর যেন শিক্ষাগ্রহণের পথে বাধা হয়ে না দাড়ায় — এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা। সর্বোপরি সবাই স্বপ্ন দেখেছিল এমন একটি গণতান্ত্রিক ও মানবিক সমাজের — যেখানে সমস্ত মানুষের মানবিক গুণাবলি বিকাশের সুযোগ অবারিত হবে, ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়-লিঙ্গের প্রভেদ থাকবে না। সবাই স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ পাবে। স্বাধীনতার ৪৭ বছরে তাদের সে স্বপ্ন কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে?
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খা — স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি সেই আকাঙ্ক্ষা বিপরীতেই দেশ পরিচালিত হয়েছে। সমাজের কোনো স্তরেই গণতান্ত্রিক চেতনার বিস্তার তো হয়ইনি বরং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের শাসক নির্বাচনের যে পদ্ধতি প্রচলিত বর্তমান শাসনামলে তাও ভূলুণ্ঠিত হয়েছে।
‘কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন’ স্লোগান তুলে সরকার পাকিস্তান আমলের আইয়ুবী স্বৈরাচারী ব্যবস্থার নতুন সংস্করণ চালু করেছে। জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনামলেও এই উন্নয়নের স্লোগান আমরা শুনেছি। যে কোনো স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় জনগণকে বিভ্রান্ত ও ভুলিয়ে রাখার মন্ত্র হিসেবে এই উন্নয়নের স্লোগান একটি চটকদার বিজ্ঞাপন মাত্র। এতে বড় বড় তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হয়।ক্ষমতাসীন সরকারও পদ্মাসেতু, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ বড় বড় প্রকল্প নিয়ে জনগণকে বোঝাতে চাইছে দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে। সত্যিই কি তাই? তাহলে উন্নয়ন বলতে আমরা কী বুঝবো? গণতন্ত্র বিসর্জন দেওয়াও কি উন্নয়নের লক্ষণ?
উন্নয়ন কখনো গণতন্ত্রের বিকল্প হতে পারে না। দীর্ঘ ২৩ বছরের পাকিস্তানি স্বৈরাচারী ব্যবস্থাকে প্রত্যাখান করে এদেশের মানুষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিল। কারণ স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার, চাওয়া-পাওয়ার প্রতিফলন ঘটে না।
ক্ষমতার সুবিধাভোগী মুষ্টিমেয়দের স্বার্থ রক্ষিত হয়। সেই ধারাতে পাকিস্তানে গড়ে উঠেছিল ২২ পরিবার। যারা দেশের অর্থনীতি-রাজনীতি সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ করত। তাদের রাহুগ্রাস থেকে মুক্তির প্রত্যয়েই জনগণ মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। দেশ স্বাধীন করেছিল। স্বাধীন দেশেও কয়েক দফা সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার আশায়। সেই আকাক্সক্ষার সুযোগ নিয়ে এখন ক্ষমতাসীন সরকার সংসদীয় স্বৈরাচারী ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে। ফলে শাসন পদ্ধতির দিক থেকে দেখতে গেলে এটা স্পষ্টতই পশ্চাদপসরণ, অগ্রগমন নয়।
একইভাবে উন্নয়ন মানে একটি দেশের মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে সম্পদের পুঞ্জীভবন ও প্রবৃদ্ধি নয়, দেশের মানুষের সামগ্রিক জীবনমানের ও জীবনযাত্রার উন্নয়ন। সেই নিরিখে এদেশের মানুষের জীবনমানের কতটুকু উন্নতি হয়েছে?
পরাধীন দেশে ছিল ২২ পরিবারের রাজত্ব। আর স্বাধীন দেশে তার স্থলে গজিয়েছে ৫০ হাজার কোটিপতি। আয়কর জমা দেয়ার নিরিখে এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব। সম্পদের পরিমাণ গোপনীয় রাখার প্রবণতা হিসাব করলে এই সংখ্যা বাস্তবে আরও বেশি হবে। এদের হাতে কোটি টাকা থেকে শুরু করে হাজার হাজার কোটি টাকা জমা হয়ে আছে। এইভাবে গত ৪৭ বছরে একদিকে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ গড়ে তুলেছে বৈভবের পাহাড়। অন্যদিকে ৪ কোটি মানুষ এখনও দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করে। জনসংখ্যার ২৫ ভাগ মানুষ তিনবেলা খেতে পায় না — কোনো রকমে খেয়ে না খেয়ে জীবন ধারণ করছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের থাকার কোনো জায়গা নেই। উদ্বাস্তু হয়ে ঢাকা শহরের ফুটপাতে খোলা আকাশের নীচে রাত্রিযাপন ও মানবেতর জীবনযাপন করছে। এইসব মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সরকারি ‘উন্নয়নে’র পরিসংখ্যানে এইসব মানুষের ঠাঁই নেই। তাহলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার সত্যিকারের চিত্র কী?
নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত সাধারণ আয়ের মানুষ বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ডাল-ভাত জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে। এই অবস্থায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। চালের মূল্য অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এক কেজি মোটা চালও ৫০ থেকে ৬০ টাকায় ক্রয় করতে হচ্ছে। পেঁয়াজের কেজি ১০০ টাকা ছুঁয়েছে। এই সরকারের দু’বারের মেয়াদে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৮ বার। গ্যাসের মূল্য ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বেড়েছে গাড়ি ভাড়া-বাড়ি ভাড়াসহ সমস্ত নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম।
শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও অবনমন ঘটছে। এই তো স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর আমাদের দেশের পরিস্থিতি। উন্নতির চিত্র! রাস্তায় চলতে ফিরতে বিলবোর্ডে কিংবা সরকারি বিজ্ঞাপনে যে উন্নয়নের চিত্র আমাদের দেখানো হয় তার সাথে বাস্তব চিত্রের কোনো মিল নেই। কিন্তু কেন নেই? কেন দেশের আজ এই পরিস্থিতি তার সঠিক কারণটা কি আমরা কখনো বোঝার চেষ্টা করেছি?
মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র অকাতরে প্রাণ দিলেও, জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করলেও সে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল এদেশের উঠতি ধনিকশ্রেণির একদল । স্বাধীনতার পর তাদের নেতৃত্বে সেই ধনিক শ্রেণির স্বার্থরক্ষার জন্য পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। আর পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূল নিয়মই হলো শোষণ। শোষণ করেই মালিকের মুনাফা বাড়ে। তাই মালিক শ্রেণির দল হিসেবে ক্ষমতায় এসে বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলো মালিকদেরই স্বার্থ রক্ষা করে, মালিকদেরই উন্নয়ন হয়। তাই এদেশে আজ ২ জন কোটিপতির জায়গায় ৫০ হাজার কোটিপতি তৈরি হয়।
অন্যদিকে দারিদ্র্য বাড়ে, বৈষম্য বাড়ে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের ৪৭বছর পর প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির খতিয়ান মেলাতে চাইলে আমাদের একথা বুঝতে হবে — শোষণমুক্ত মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে হলে শোষণের বৃষবৃক্ষ যে পুঁজিবাদ — তাকে উপড়ে ফেলতে হবে। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। না হলে শোষণমুক্তির স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে।
মো:মেহেদী হাসান।
হিসাবরক্ষক, কালটেক্স পেট্রোলিয়াম।
মালয়েশিয়া।
২৭/০৩/২০১৮ ইং
গত ৪৭ বছরে যারাই ক্ষমতায় এসেছে — নিজেদের মত করে সাজিয়েছে ইতিহাসের বয়ান। তাদের সেই কীর্তিস্তম্ভে চাপা পড়েছে এদেশের শ্রমিক-কৃষকের কণ্ঠস্বর। যে হাড়জিরজিরে কৃষক-শ্রমিক একদিন নেংটি পড়ে জীবন মৃত্যু তুচ্ছ করে ঝাপিয়ে পড়েছিল স্বদেশকে মুক্ত করার ব্রতে, যে ছাত্র একদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর তথাকথিত ভবিষৎ ক্যারিয়ারের স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে জীবন আহুতি দিয়েছিল দেশবাসীর স্বপ্নপূরণে — আজকে বিজয় দিবসের সভায়- স্লোগানে তাদের নাম নেই, তাদের স্বপ্নের কথা সেখানে আর উচ্চারিত হয় না। ঘর-বাড়ি, বাবা-মা, প্রিয়জনের সান্নিধ্য ছেড়ে কোন্ স্বপ্নে তারা জীবন বাজি রেখেছিল?
পাকিস্তানি প্রায়-ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণে প্রাণ ওষ্ঠাগত শ্রমিক চেয়েছিল এমন একটি দেশ — যেখানে মানবিক জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সে সংগ্রহ করতে পারবে এমন মজুরি, কৃষক চেয়েছিল— তার শ্রমে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম সে পাবে, বারো মাস খাবার জুটবে, সন্তানের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারবে। ছাত্ররা চেয়েছিল — একটি মানুষও যেন শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, অর্থের প্রাচীর যেন শিক্ষাগ্রহণের পথে বাধা হয়ে না দাড়ায় — এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা। সর্বোপরি সবাই স্বপ্ন দেখেছিল এমন একটি গণতান্ত্রিক ও মানবিক সমাজের — যেখানে সমস্ত মানুষের মানবিক গুণাবলি বিকাশের সুযোগ অবারিত হবে, ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়-লিঙ্গের প্রভেদ থাকবে না। সবাই স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ পাবে। স্বাধীনতার ৪৭ বছরে তাদের সে স্বপ্ন কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে?
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খা — স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি সেই আকাঙ্ক্ষা বিপরীতেই দেশ পরিচালিত হয়েছে। সমাজের কোনো স্তরেই গণতান্ত্রিক চেতনার বিস্তার তো হয়ইনি বরং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের শাসক নির্বাচনের যে পদ্ধতি প্রচলিত বর্তমান শাসনামলে তাও ভূলুণ্ঠিত হয়েছে।
‘কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন’ স্লোগান তুলে সরকার পাকিস্তান আমলের আইয়ুবী স্বৈরাচারী ব্যবস্থার নতুন সংস্করণ চালু করেছে। জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনামলেও এই উন্নয়নের স্লোগান আমরা শুনেছি। যে কোনো স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় জনগণকে বিভ্রান্ত ও ভুলিয়ে রাখার মন্ত্র হিসেবে এই উন্নয়নের স্লোগান একটি চটকদার বিজ্ঞাপন মাত্র। এতে বড় বড় তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হয়।ক্ষমতাসীন সরকারও পদ্মাসেতু, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ বড় বড় প্রকল্প নিয়ে জনগণকে বোঝাতে চাইছে দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে। সত্যিই কি তাই? তাহলে উন্নয়ন বলতে আমরা কী বুঝবো? গণতন্ত্র বিসর্জন দেওয়াও কি উন্নয়নের লক্ষণ?
উন্নয়ন কখনো গণতন্ত্রের বিকল্প হতে পারে না। দীর্ঘ ২৩ বছরের পাকিস্তানি স্বৈরাচারী ব্যবস্থাকে প্রত্যাখান করে এদেশের মানুষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিল। কারণ স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার, চাওয়া-পাওয়ার প্রতিফলন ঘটে না।
ক্ষমতার সুবিধাভোগী মুষ্টিমেয়দের স্বার্থ রক্ষিত হয়। সেই ধারাতে পাকিস্তানে গড়ে উঠেছিল ২২ পরিবার। যারা দেশের অর্থনীতি-রাজনীতি সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ করত। তাদের রাহুগ্রাস থেকে মুক্তির প্রত্যয়েই জনগণ মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। দেশ স্বাধীন করেছিল। স্বাধীন দেশেও কয়েক দফা সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার আশায়। সেই আকাক্সক্ষার সুযোগ নিয়ে এখন ক্ষমতাসীন সরকার সংসদীয় স্বৈরাচারী ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে। ফলে শাসন পদ্ধতির দিক থেকে দেখতে গেলে এটা স্পষ্টতই পশ্চাদপসরণ, অগ্রগমন নয়।
একইভাবে উন্নয়ন মানে একটি দেশের মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে সম্পদের পুঞ্জীভবন ও প্রবৃদ্ধি নয়, দেশের মানুষের সামগ্রিক জীবনমানের ও জীবনযাত্রার উন্নয়ন। সেই নিরিখে এদেশের মানুষের জীবনমানের কতটুকু উন্নতি হয়েছে?
পরাধীন দেশে ছিল ২২ পরিবারের রাজত্ব। আর স্বাধীন দেশে তার স্থলে গজিয়েছে ৫০ হাজার কোটিপতি। আয়কর জমা দেয়ার নিরিখে এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব। সম্পদের পরিমাণ গোপনীয় রাখার প্রবণতা হিসাব করলে এই সংখ্যা বাস্তবে আরও বেশি হবে। এদের হাতে কোটি টাকা থেকে শুরু করে হাজার হাজার কোটি টাকা জমা হয়ে আছে। এইভাবে গত ৪৭ বছরে একদিকে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ গড়ে তুলেছে বৈভবের পাহাড়। অন্যদিকে ৪ কোটি মানুষ এখনও দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করে। জনসংখ্যার ২৫ ভাগ মানুষ তিনবেলা খেতে পায় না — কোনো রকমে খেয়ে না খেয়ে জীবন ধারণ করছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের থাকার কোনো জায়গা নেই। উদ্বাস্তু হয়ে ঢাকা শহরের ফুটপাতে খোলা আকাশের নীচে রাত্রিযাপন ও মানবেতর জীবনযাপন করছে। এইসব মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সরকারি ‘উন্নয়নে’র পরিসংখ্যানে এইসব মানুষের ঠাঁই নেই। তাহলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার সত্যিকারের চিত্র কী?
নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত সাধারণ আয়ের মানুষ বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ডাল-ভাত জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে। এই অবস্থায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। চালের মূল্য অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এক কেজি মোটা চালও ৫০ থেকে ৬০ টাকায় ক্রয় করতে হচ্ছে। পেঁয়াজের কেজি ১০০ টাকা ছুঁয়েছে। এই সরকারের দু’বারের মেয়াদে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৮ বার। গ্যাসের মূল্য ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বেড়েছে গাড়ি ভাড়া-বাড়ি ভাড়াসহ সমস্ত নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম।
শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও অবনমন ঘটছে। এই তো স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর আমাদের দেশের পরিস্থিতি। উন্নতির চিত্র! রাস্তায় চলতে ফিরতে বিলবোর্ডে কিংবা সরকারি বিজ্ঞাপনে যে উন্নয়নের চিত্র আমাদের দেখানো হয় তার সাথে বাস্তব চিত্রের কোনো মিল নেই। কিন্তু কেন নেই? কেন দেশের আজ এই পরিস্থিতি তার সঠিক কারণটা কি আমরা কখনো বোঝার চেষ্টা করেছি?
মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র অকাতরে প্রাণ দিলেও, জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করলেও সে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল এদেশের উঠতি ধনিকশ্রেণির একদল । স্বাধীনতার পর তাদের নেতৃত্বে সেই ধনিক শ্রেণির স্বার্থরক্ষার জন্য পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। আর পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূল নিয়মই হলো শোষণ। শোষণ করেই মালিকের মুনাফা বাড়ে। তাই মালিক শ্রেণির দল হিসেবে ক্ষমতায় এসে বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলো মালিকদেরই স্বার্থ রক্ষা করে, মালিকদেরই উন্নয়ন হয়। তাই এদেশে আজ ২ জন কোটিপতির জায়গায় ৫০ হাজার কোটিপতি তৈরি হয়।
অন্যদিকে দারিদ্র্য বাড়ে, বৈষম্য বাড়ে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের ৪৭বছর পর প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির খতিয়ান মেলাতে চাইলে আমাদের একথা বুঝতে হবে — শোষণমুক্ত মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে হলে শোষণের বৃষবৃক্ষ যে পুঁজিবাদ — তাকে উপড়ে ফেলতে হবে। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। না হলে শোষণমুক্তির স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে।
মো:মেহেদী হাসান।
হিসাবরক্ষক, কালটেক্স পেট্রোলিয়াম।
মালয়েশিয়া।
২৭/০৩/২০১৮ ইং