হুড তুলে রিকশা চড়া কোনকালেই আমার পছন্দের ছিলো না।সেদিন বিকেলে পিচ্চি শায়নকে কোলে বসিয়ে রিকশা করে শপিং মলের দিকে যাচ্ছিলাম। রাস্তায় পরিচিত-অপরিচিত অনেকেই আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছিলো।এসব একেবারেই ভালো লাগেনা,সবসময় ওদের এতো কৌতূহল থাকবে কেন?যেখানে আমার লুকিয়ে যেতে ইচ্ছে করে,নাহ ওদের কৌতূহল তখন বেড়ে যাবে।মাত্র দেড়-দুই বছরের শায়নটা ও এতো কিউট হয়েছে,মানুষ কার দিকে তাকায় সেটাই বুঝে উঠতে পারিনা।তাও ওদের বুঝা উচিত ভূত দেখার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা মানে অন্যকে অপ্রস্তুত করে ফেলা।শায়নকে কোল থেকে নামানোর ও কোন উপায় নেই,নামালেই অমনি হেঁটে হেঁটে এর ওর কাছে চলে যায়।তারপর, আবার এটা কি আপনার ছেলে,অনেক কিউট তো,এমন আরো কতশত প্রশ্ন।উত্তর দিয়ে দিয়ে পেরে না উঠলে তারপর এড়িয়ে যাই।
কিন্তু,কলিগ পলাশ বাবু আজ কি জানতে চাইলেন ওর ব্যাপারে অমন করে।ওকে আমি কি আসলেই ভালোবাসি?এর অর্থ কি?নাহ,একটু কেমন জানি লাগছে।নতুন চাকরি,নতুন পরিবেশ,নতুন সব কলিগ,নাহ সবার প্রতি আন্তরিক হয়ে উঠতে না পারলেই খুব অভদ্রতা হবে।অমনিই পলাশ বাবুকে মেসেঞ্জারে নক করলো নীলা।
নীলা::হ্যালো স্যার ফ্রি আছেন?
পলাশ::হাঁ বলুন,কেমন আছেন?
নীলা::হুম আছি।আচ্ছা,আজ আপনি কেন এমন করে কথাটা বললেন?
পলাশ::কি বলেছি।ওহহ আচ্ছা,এমনি জানতে চাইলাম শায়নকে আপনি কতটুকু ভালোবাসেন,সেতো অনেক কিউট এমনিও,ভালো না বেসে পারা যায়না।
নীলা::আপনি কি বলতে চাচ্ছেন?স্পষ্ট করে বললে খুশি হতাম।এমন আচরণ আমি ডিজার্ভ করিনা।
পলাশ::সত্যি কথাই বলি,সেদিনে অফিসে গুঞ্জন শোনা গেলো ওকে নিয়ে।
নীলা::কেন?শায়ন আমার নাতি হয় সেটাতো বলেছি আপনাদেরকে।
পলাশ::কিন্তু,সেটাকে ফান ভেবেই উড়িয়ে দিয়েছি আমরা।আপনিতো আর কিছু বললেন না।
নীলা::ফান ভাবুন কিংবা সিরিয়াস ভাবুন সেটা যার যার পার্সোনাল ব্যাপার।বাট সে যে আমার হাজবেন্ড এর প্রথম স্ত্রীর ঘরের মেয়ে কেয়ার ছেলে সেটাকি অকারণেই সবাইকে বলে বেড়াবো?
পলাশ ::আপনার জীবনে এমনটা কেন ঘটলো আর এটা হতে দিলেনই বা কেন সেটাই ভেবে পাইনা,কোনদিন বললেন ও না।
নীলা::কার জীবনে কখন কি ঘটে সেটাকি আগে থেকে বলতে পারা যায়?আমার হাজবেন্ড বা আমি কি জানতাম কেয়া ওর ছেলে শায়নকে নিয়ে স্বামীর ঘর ছেড়ে একেবারেই বাবার ঘরে এসে উঠবে!!!কেয়া ও কি জানতো!!!
আচ্ছা,কালকে অফিসে দেখা হচ্ছে।ঘুমিয়ে পড়ুন।শুভ রাত্রি।
পলাশ::ভালো থাকুন।শুভ রাত্রি,ম্যাডাম।
সিয়াম সাহেব বিষন্নমুখে বসে আছেন বারান্দায়।নীলা কাছে গিয়ে এক কাপ চা এগিয়ে দেয়।নাহ,সিয়াম সাহেবের কোন সাড়া নেই।নীরবতা ভেঙে নীলা বললো,শোন ভাবছি আজ বিকেলে কেয়াকে নিয়ে বাইরে একটু ঘুরতে যাবো।হঠাৎ অবাক করে দিয়ে সিয়াম সাহেব ডুকরে কেঁদে উঠলেন।নীলা,এতো করে বোঝায় তাও সিয়াম সাহেব যেন বুঝবেনা এমন।
সিয়াম সাহেব::নীলা,একটা সত্যি কথা বলবে?
নীলা::হ্যা,বলো।
সিয়াম ::আমার সাথে বিয়ে হয়ে তোমার কি আফসোস হয়না?
নীলা::নাহ,কেন হবে?
সিয়াম সাহেব এবার আরো চুপ হয়ে গেলেন। বিষন্নমনে জানলার দিকে তাকিয়ে আছেন।নীলা বুঝতে পারলো ব্যাপারটা।নীলা একসময়ে বন্ধুমহলে সবচেয়ে সুন্দরী,স্মার্ট,বুদ্ধিমতী মেয়েটি ছিলো।সিয়াম সাহেবকে যদিও ভালোবেসে বিয়ে করেনি,তবে বিয়ে করে অনেক ভালোবেসে ফেলেছে।সিয়াম সাহেবের জীবনে না এলে নীলা যেন নিজেকেই চিনে উঠতে পারতো না,এতো সমৃদ্ধ জীবন হতো না ওর।সিয়াম সাহেব ছিল নীলার বড় ভাইয়ার বন্ধু, একই সাথে ভার্সিটিতে পড়তো।সেসময় কেয়ার মায়ের সাথে উনার প্রেম ছিল,চার-পাঁচ বছর পর পরিবারের মতেই ওদের বিয়ে হয়।খুব ভালোবাসা ছিল ওদের মধ্যে।নীলা যদিও অনেক জুনিয়র ছিল,তাও ওদের এতো প্রেম-ভালোবাসা ছিল দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবে ওরা কতটা ভালোবাসে দুজন দুজনকে।বছর ঘুরতেই কেয়া আসে ওদের কোলজুড়ে।কেয়া একটু বড় হলে,ওরা আবার বাচ্চা নেয়ার প্ল্যান করে।হঠাৎই কেয়ার মায়ের জরায়ু ক্যান্সার ধরা পরে।কিন্তু,সিয়াম সাহেব সেটা স্ত্রীকে বুঝতে দেননি,উন্নত চিকিৎসা করিয়েছিলেন। তাও শেষমেশ মৃত্যু এসে কেয়ার মাকে নিয়ে গেল কেয়ার কাছ থেকে, সিয়াম সাহেব ও একা হয়ে গেলেন।এভাবেই দিন কাটলো না।সিয়াম সাহেবের বাবা-মা নীলাদের বাসায় প্রস্তাব নিয়ে আসেন বিয়ের।উনাদের ইচ্ছেতেই বিয়েটা হয়েছিল।যদিও নীলার বাবা-মা ব্যাপারটা মানতে পারেনি,কিন্তু নীলা অমত করেনি বলেই বিয়েটা হয়েছিল।সিয়াম সাহেবের বাড়িতে এসে নীলার একবারের জন্য ও মনে হয়নি,কেয়া ওর মেয়ে নয় কিংবা সিয়াম সাহেব অন্য কারো স্বামী ছিল।নীলার খুব আপন মনে হতে লাগলো সবকিছু।কেয়া ও নীলাকে আপন করে নিয়েছিল।আর সিয়াম সাহেব ও নীলাকে এতোটা ভালোবাসবে সেটা নীলার ধারণায় ছিল না।তবে,নীলা কখনো চায়নি কেয়ার মায়ের স্মৃতি সিয়াম সাহেবের মন থেকে একেবারেই মুছে যাক।নীলা দেখতে চায়,তাঁর স্বামী অনেক বড় মনের মানুষ, যে কিনা তাঁর স্ত্রীদের অনেক ভালোবাসে।অধিকার না জন্মিয়ে অধিকার খাটাতে আসেন না এই পুরুষ।সিয়াম সাহেব তো তাঁর স্ত্রীকে মেরে ফেলেন নি,বা তাঁর থাকাকালে কোন নারীর দিকে খারাপ নজর ও দেননি।স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে মেয়ের কথা চিন্তা করে আর বাবা-মায়ের ইচ্ছাকে মূল্য দিয়েই আবার বিয়ের পিড়িতে বসেছে।নীলাকে বিয়ে করে এনে ও কোন অধিকার বঞ্চিত করেনি।সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসেছে, সম্মান করেছে।কেয়াকে ও সুপাত্র দেখে বিয়ে দিয়েছে।তাহলে এই মানুষটার দোষ কোথায়? এই মানুষটাকে তো অনেক ভালোবাসতে ইচ্ছে করে নীলার।শুধুই নিজের ভাবতে ইচ্ছে করে,এই মানুষটার কাঁধে মাথা রেখে হাজার জনম কাটাতে ইচ্ছে করে।অনেক ভালো আছে নীলা,অনেক সুখে আছে এই মানুষটাকে পেয়ে,কেয়াকে পেয়ে।কেয়া তো মা ডেকে ডেকেই অস্থির।কেয়ার মা ডাক শুনতে শুনতে নীলা যেন মাতৃত্ব আগেই চিনে গিয়েছিল।কেয়ার পরে কথা আসলো ওদের জীবনে।দুই মেয়ে নিয়েই ওদের ছোট্ট হাসি-খুশির সংসার ছিল।কেয়াকে সুপাত্র দেখে আমেরিকা প্রবাসী ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছিল।কিন্তু,মাসখানেক আগে কেয়া বাচ্চাসহ বাবার বাড়িতে চলে এসেছে একেবারে।এ কারণে সিয়াম সাহেবের মনটা বিষন্ন।একেতো প্রেসার ডিস্টার্ব করে,তার উপর এতো টেনশন সিয়াম সাহেব নিতে পারবে কিভাবে!!নীলা স্বাভাবিক হয়েই বলে,আচ্ছা প্লিজ তুমি এতো টেনশন করো না।
সিয়াম সাহেব বলে,আচ্ছা আমার জীবনে এতো অঘটন কেন বলোতো নীলা।
নীলা::আমাকে ও কি তোমার অঘটন বলে মনে হয়?
সিয়াম ::আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি সেটা কি কারো সাথে তুলনা করতে যাও তুমি?
নীলা::নাহ, এ কথা আর কক্ষনো বলবে না।আমি জানি,আমি তোমার ভালোবাসা পেয়েছি, যা অনেকেই পায়না,এর বেশি আমার আর কিছু চাইনা।
সিয়াম ::মাঝেমাঝে কি কষ্ট হয় তোমার?
নীলা ::সেই তুমি এখনো সেটা ভাবছো?
সিয়াম ::আমি তো দেখছিই তোমাকে কিরকম পরিস্থিতিতে পরতে হয়।
হুম সেটা নতুন কিছু নয়,কয়েকদিন আগে অফিস কলিগ পলাশ বাবুও এরকম ইস্যু টেনে এনেছিলেন নীলা ভাবে।সামলে নিয়ে নীলা বলে,সে যাই হোক,ওদের কথায় আমি কান দেইনা।ওরা ভালো আছি দেখে হিংসে করে।আচ্ছা, বলোতো আমাদের মতো সুখী কয়জন আছে?
সিয়াম ::একটু ও কষ্ট হয়না নীলা!!
নীলা::তুমি ও কি আমার চোখের জল দেখার পৈশাচিক আনন্দ নিতে চাও?মানুষগুলো এমন কেন হয়?আমরা ভালো আছি জেনেও কেন খারাপ থাকার ইশারাতে ডাকছে?কেন আমাদেরকে আমাদের মতো থাকতে দেয় না?আমাদের সুখী হওয়াটাই কি অস্বাভাবিক? নীলার চোখের জল সিয়াম সাহেবের বুকে গিয়ে পোঁছোয়।দুজনের চোখের জলে ঝাপসা হয়ে যায় কিছু অনুভূতি, কিছু সময়।এভাবেই ঝাপসা আর স্পষ্ট হতে হতেই অনুভূতিগুলো অনুভবে মিশে যাচ্ছে।